ততক্ষণ পথচারীরা যে যা পেল, তাই দিয়ে আঁড়টাকে মারতে লাগল। আর দু তিন জন রশি ধরে টানতে লাগল।
ষাঁড়টা বেগতিক দেখে কয়েক পা পিছিয়ে এল। এমন সময় ষাড়ের মালিক জহুর এসে ষাঁড়টাকে আদর করে রশি ধরে হাসানকে বলল, এবার ছেড়ে দিন স্যার।
হাসান ছেড়ে দিয়ে বলল, এরকম মার কুত্তো ষাঁড়কে রাস্তায় বেঁধে রাখা আপনার ঠিক হয়নি।
জহুর বলল, এ আমার ঘরের গাইয়ের বাছুর। খুব শান্ত। কখনো কাউকে গুতোয়। তারপর রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, বোরখা পরা মেয়েকে দেখে হয়তো আজ এই কাণ্ড করল। আমার ছোট ছেলেটা দূর থেকে দেখে আমাকে ডাকার জন্য ঘরে গিয়েছিল। আমি ও পাড়ায় গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনে ছুটে এসেছি।
ষাঁড়টাকে তার পিছনে ছুটতে দেখে রুকসানা ছুটার সময় দেওয়া ইউনুছ পড়ছিল, ষাঁড়টা যখন তার খুব কাছে এসে গিয়েছিল তখন তার মনে হয়েছিল, ষাঁড়টা তাকে শিং দিয়ে গুতিয়ে ফালা ফালা করে ফেলবে। তাই মনে মনে বলেছিল, আল্লাহ গো, তুমি আমাকে রক্ষা কর। হাসান ধাক্কা দেওয়ার আগেই জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়েছিল। ক্ষেতে পড়ে হাতে পায়ে কিছু আঘাত পেলেও তার মনে হল, যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচাল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে এতক্ষণ ষাঁড় ও মানুষের লড়াই দেখছিল। আর হাসান স্যারের সাহস ও শক্তি দেখে খুব অবাক হল। জহুর ষাঁড় নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার কোথাও লাগেনি তো স্যার?
হাসান বলল, না আমার কিছু হয়নি। আপনারা এবার যান। তারপর রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে ধাক্কা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তবু ক্ষমা চাইছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, পড়ে গিয়ে নিশ্চয় আঘাত পেয়েছেন?
রুকসানা বলল, আঘাত পেলেও তা সামান্য। আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই। শুধু এটুকু বলব, আপনি আমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ভাবছি আঘাত পেয়েছেন কিনা?
হাসান সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন, আমি ওসিলা মাত্র। তারপর বলল, একা যেতে পারবেন, না পৌঁছে দেব?
রুকসানা বলল, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, একাই যেতে পারব।
ঠিক আছে, আসি তা হলে বলে হাসান হাঁটতে শুরু করল।
ততক্ষণে লোকজন সব চলে গেছে। রুকসানা বলল, শুনুন।
হাসান কিছুটা চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, কিছু বলবেন?
রুকসানা বলল, লোকজন আপনাকে স্যার বলছিল। আপনি কী স্কুলের টিচার?
হাসান বলল, হ্যাঁ।
আপনার নামটা বললে খুশি হতাম।
হাসান।
বাড়ি?
হাসান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আমি ঢাকা থেকে এসে কয়েক মাস হল এখানকার গার্লস হাই স্কুলে জয়েন করেছি।
রুকসানার তখন সামাদের কথা মনে পড়ল। ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ঢাকা থেকে একটা ভালো টিচার এসেছেন। ভাবল, ইনিই সেই টিচার ননতো? বলল, আপনি ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক?
জ্বি।
আমি আব্দুল মতিন চৌধুরীর বড় মেয়ে রুকসানা। একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাহিরবাগ গ্রামে গিয়ে যে কাউকে চৌধুরী বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।
হাসান কয়েক সেকেণ্ড একদৃষ্টে তার কালো চশমা পরা চোখের দিকে চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আসব। এবার আসি, তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে হাঁটতে লাগল।
রুকসানাও আল্লাহ হাফেজ বলে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ফেরার পথে ভাবতে লাগল, ভদ্রলোক যেমন শক্তিশালী তেমনি সাহসী। উনি যদি ঠিক সময়ে এসে না পড়তেন, তা হলে কি হত ভেবে শিউরে উঠল। ঘরে এসে আব্বা আম্মাকে ঘটনাটা জানাল।
আজিজা বেগম বললেন আল্লাহ লোকটার ভালো করুক। তোকে কতবার বলেছি একা কোথাও যাবি না, কাউকে সঙ্গে নিবি।
আব্দুল মতিন বললেন, লোকটাকে চিনিস?
রুকসানা বলল, না। তবে পরিচয় জেনেছি। নাম হাসান। সেদিন সামাদ মনিরাদের স্কুলের যে একজন ভালো টিচারের কথা বলেছিল, মনে হয় উনিই তিনি।
আব্দুল মতিন বেশ অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? একটা শহরের লোক ষাঁড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোকে বাঁচাল, খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো?
হ্যাঁ আব্বা, শুধু আমি নই, রাস্তার যত লোক ছিল সবাই খুব অবাক হয়েছে।
তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি না কেন?
উনি আমাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, আমি না করেছি? তবে একদিন আসতে বলেছি।
সামাদ যার কথা বলেছিল, উনি যদি তিনি হন, তা হলে এলে মনিরাকে পড়াবার ব্যবস্থা করিস।
ঠিক আছে, তাই করব বলে, রুকসানা নিজের রুমে এসে কাপড় পাল্টে মনিরাকে ডেকে বলল, তোদের স্কুলে ঢাকা থেকে একজন ভালো টিচার এসেছে। শুনলাম, তার নাম কি বলতো?
মনিরা বলল, পুরো নামতো জানি না। সবাই হাসান স্যার বলে। জান বড় আপা, স্যার খুব ভালো পড়ায়; কিন্তু ভীষণ কড়া, কোনো ছাত্রী যদি বেয়াদবি করে অথবা। পড়া না করে আসে তা হলে আর রক্ষে নেই। সে যত বড় লোকের মেয়ে হোক না। কেন, সারা পিরিয়ড বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখেন।
রুকসানা বলল, ভাবছি, তোকে পড়াবার জন্য ওঁকেই রাখার ব্যবস্থা করব।
ওরে বাবা, উনি যা কড়া টিচার। ওঁর দিকে তাকালেই ভয় লাগে। পড়ব কি করে? না বাবা না, আমি ওঁর কাছে পড়ব না।
তুই তো নিজেই বললি, উনি খুব ভালো টিচার। শোন, ভালো টিচাররা একটু কড়া হন। বেয়াদবি মোটেই পছন্দ করেন না। তুই ওঁর সঙ্গে বেয়াদবি না করলে তোকে কিছু বলবেন না।