রুকসানা মৃদু হেসে বলল, ঐ ঘটনার দিন কাদা-মাটি দিয়ে জাহাজ বানাবার সময় হঠাৎ করে আমার চশমা খুলে ফেলেছিল। আমি মুখ নিচু করে নিতে চিবুক ধরে তুলে চশমা পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, চশমা ছাড়া তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়। কাল থেকে এখানে এসে চশমা খুলে রাখবে। ইকবাল ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা বলেনি। তাই এইসব কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে ইচ্ছা করেনি।
সুরাইয়া বলল, ছোটবেলার ঘটনায় অনুশোচনা হতে পারে, তাই বলে এভাবে জীবন কাটান কী ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া সে হয়তো এতদিনে বিয়ে করে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার করছে। তোমার কথা কী মনে রেখেছে?
রুকসানা বলল, আমিও যে সেকথা ভাবিনি, তা নয়; কিন্তু মন সায় দেয় না। বলে, সেও তোমার জন্য বিয়ে না করে জীবন কাটাচ্ছে।
তাই যদি হয়, তাহলে এত বছর কোনো যোগাযোগ করেনি কেন? আচ্ছা, আসমা আপা তো মাঝে মধ্যে আসে, ইকবাল ভাইয়ের কথা তার কাছে জিজ্ঞেস কর নি?
করি নি আবার, যখনই আসে তখনই জিজ্ঞেস করি। বলে সেই যে এস. এস. সি. পাশ করে এসেছিল তারপর আর আসা তো দূরের কথা, একটা চিঠিও দেয়নি।
এমন সময় করিমন এসে সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, বড় ভাই আপনাকে ডাকছেন।
রুকসানা তাকে বলল, তুমি যাও, ও যাচ্ছে। করিমন চলে যাওয়ার পর রুকসানা বলল, ওয়াদার কথা মনে আছে তো?
সুরাইয়া বলল, ওয়াদা যখন করেছি, মনে তো থাকবেই। তবে এ ব্যাপারে আরো কিছু জানার আছে। সময় মতো জানব বলে চলে গেল।
২. পূর্ব পুরুষদের কাঁচারি বাড়িটা
পূর্ব পুরুষদের কাঁচারি বাড়িটা মূল বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সেটা এতদিন এমনি পড়েছিল। রুকসানা সেখানে কুটির শিল্পের কারখানা করেছে। কাঁচারী বাড়ির সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা বন জঙ্গলে ভরেছিল। কারখানায় শ্রমিকদের নিয়ে পরিষ্কার করে ফুলের বাগান করেছে। কারখানার প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন কাজ করে। তাদের মধ্যে অর্ধেক মেয়ে। তারা সবাই একই কারখানায় কাজ করলেও মেয়েদের বিভাগ আলাদা। সেখানে কোনো পুরুষ কাজ করে না। দুই বিভাগের মাঝখানে তিনটে অফিস রুম। মাঝ খানের রুমে রুকসানা বসে। অন্য দুটোর একটায় মেয়েদের পরিচালক রাবিয়া ও অন্যটায় পুরুষদের পরিচালক কায়সার বসে। দুজনেই একই গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। কলেজে পড়ার সময় মন দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেছে। তারা রুকসানার সহপাঠী ছিল। গ্রামে ফিরে তিন জনে মিলে সমাজ কল্যাণে নেমেছে। রাবিয়াও কায়সার আর্থিক সহযোগিতাও করেছে। যা কিছু করেছে তিন জনে পরামর্শ করেই করেছে।
আজ রুকসানা অফিসে আসার ঘণ্টাখানেক পরে রাবিয়া এসে বলল, পলাশপুরের সাজেদা তিন দিন কাজে আসেনি। কাল ঐ গ্রামের আনোয়ারকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম? কিছুক্ষণ আগে সে বলল, সাজেদার খুব অসুখ।
রুকসানা বলল, তাই নাকি? তা হলে তো তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। বিকেলে তুই ও কায়সার আলতাফ ডাক্তারকে নিয়ে যাস।
রাবিয়া বলল, ও তো আজ আসেনি। বিকেলে আমার ননদকে দেখার জন্য ছয় সাতজন লোক আসবে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। তুই না হয় ডাক্তার নিয়ে যাস।
রুকসানা বলল, ঠিক আছে, তাই যাব।
বিকেলে রুকসানা আলতাফ ডাক্তারকে নিয়ে পলাশপুর গেল। আলতাফ ডাক্তার। সাজেদাকে দেখে প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে পাশের গ্রামে রুগী দেখার জন্য চলে গেল।
সাজেদা বিয়ের পাঁচ বছর পর বিধবা হয়ে দুটো ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। বাবা আবেদ খেটে খাওয়া মানুষ। তার তিন ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে। আবেদের বয়স হয়েছে। তেমন খাটা খাটনি করতে পারে না। তাছাড়া। বছরের প্রায় অর্ধেক দিন গ্রামে কাজ পাওয়া যায় না। কোনো রকমে এক বেলা এক সন্ধ্যে খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল। সাজেদা দুটো ছেলে নিয়ে বিধবা হয়ে আসার পর সংসারে আরো বেশি অভাব দেখা দেয়। রুকসানা জানতে পেরে সাজেদাকে। কারখানায় লাগিয়েছে।
সাজেদার কাছ থেকে ফেরার পথে রুকসানা রাস্তার পাশে একটা বাঁধা ষাঁড়কে পাশ কেটে কিছুটা এগিয়েছে এমন সময় হঠাৎ ষাঁড়টা বোরখা পরা রুকসানাকে দেখে গোঁ গোঁ করে উঠে লাফালাফি করে রশি ছেঁড়ার চেষ্টা করল। রুকসানা তা বুঝতে। পেরে ভয় পেয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল, আর একবার করে পিছন ফিরে ষাঁড়টার দিকে তাকাতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ডর মধ্যে ষাঁড়টা রশি ছিঁড়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে দেখে ভয় পেয়ে রুকসানাও প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু বোরখা পরে থাকার কারণে ষাঁড়টার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না।
হাসান রুকসানার বিপরীত দিক থেকে আসছিল। দূর থেকে একটা ষাঁড়কে বোরখা পরা একটা মেয়েকে তাড়া করছে দেখতে পেয়ে খুব দ্রুত দৌড়ে আসতে লাগল।
ষাঁড়টা যখন রুকসানার খুব কাছাকাছি এসে গেল তখন হাসানও সেখানে পৌঁছে গেল। রোকসানাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে ক্ষেতে ফেলে দিয়ে ষাঁড়টার দুটো শিং ধরে প্রাণপণ শক্তিতে ঝাঁকি দিল।
ষাঁড়টা তাতেও দমল না। হাসানকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চলল। হাসান এবার একটা হাতে শিং ধরে রেখে অন্য হাতের আঙ্গুলগুলো দু’নাকের ভিতর ঢুকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘাড়ে মোচড় দিয়ে ষাঁড়টাকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। ষাঁড়টা বোধ হয় প্রতিপক্ষের শক্তি বুঝতে পেরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা করল।