কাজেম ছেলেকে কখনো কোনো অন্যায় করতে দেখেনি। তাই তাকে মারাতো দূরের কথা কোনোদিন শাসন করার কথাও ভাবেনি। আজ তার অন্যায়ের কথা শুনে যতটা না শাস্তি দিত, সাহেবকে খুশি করার জন্য তার চেয়ে বেশি শাস্তি দিয়ে ফেলেছে। এখন স্ত্রীর কথা শুনে খুব অনুশোচনা হল। সত্যি যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়। কথাটা মনে হতে ডাক্তার নিয়ে আসে। চব্বিশ ঘণ্টা পর ইকবালের জ্ঞান ফিরে আসে। এর কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে কোথায় চলে যায়। কাজেম চাচা ও নাজমা চাচি আব্বার পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সে কথা জানায়।
আব্বা তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তোমরা ঘরে যাও, আমি ইকবালকে খোঁজার ব্যবস্থা করছি। আব্বা সামসু ও জাবেদকে ইকবালকে খুঁজতে বললেন। তারা বেশ কয়েকদিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খোঁজ করল, কিন্তু ইকবালকে পাওয়া গেল না।
কাজেম চাচা একমাত্র ছেলের ভালোমন্দ চিন্তা করে খুব ভেঙ্গে পড়ে। প্রায় আব্বার কাছে এসে কান্নাকাটি করে বলত, আমি ইকবালকে মেরে ফেলেছি। আব্বা তাকে বোঝাতো, ইকবাল রাগ করে কোথাও চলে গেছে। রাগ পড়ে গেলে ফিরে আসবে।
ছমাস পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন ইকবাল ফিরে এল না তখন একদিন কাজেম চাচা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাচিকে নিয়ে নিজের গ্রামে চলে যায়। আমি দাদিকে ইকবালকে মারার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। দাদি বলেছিলেন, স্বামী ছাড়া মেয়েদের বুকে হাত দেওয়া অন্য পুরুষের জন্য খুব বড় অপরাধ। তখন কথাটার মূল্য বুঝতে না পারলেও বড় হয়ে বুঝেছি। তবু তখন আমার কেবলই মনে হত, বুকে হাত দেওয়ার কথাটা আম্মাকে বলা ঠিক হয়নি। আমার কারণে ইকবাল এতবড় শাস্তি পাবে ভাবিনি। তখন তাকে শিশুসুলভ ভালবাসলেও মার খেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর। আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। তারপর যত বড় হয়েছি তত বেশি তাকে ভালবেসে ফেলেছি।
কাজেম চাচার বাড়ি দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে। আমার সই আসমার বাড়িও ঐ গ্রামে। আর সয়া দাইহান হল কাজেম চাচার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তখন অবশ্য ওসব কথা জানতাম না। আসমার সঙ্গে সই পাতাই ক্লাস সেভেনে। ওর কাছে কাজেম চাচার খোঁজ নিতাম। নিজের বাড়িতে গিয়ে কাজেম চাচা ছেলের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল। নাজমা চাচি এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে সংসার চালাত। একদিন কি কারণে যেন এক পিরিয়ডের পর ছুটি হয়ে যায়। সেদিন আসমার সঙ্গে কাজেম। চাচাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে কাজেম চাচা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি ইকবালের সাথে খেলা করতে এসেছ? সে তো নেই। অনেক দিন হল আমার উপর রাগ করে কোথায় চলে গেছে। নাজমা চাচিও আমাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক কেঁদেছিল। তারপর আর তাদের বাড়ি যাইনি। মাঝে মধ্যে আসমার হাতে। কিছু কিছু টাকা নাজমা চাচিকে পাঠাতাম। এইটে পড়ার সময় আসমা একদিন বলল, কাজেম চাচা মারা গেছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। নাইনে পড়ার সময় নাজমা চাচিও মারা যায়। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আসমা যেদিন বলল, সে তাদের গ্রামের দাইহান নামে একটা গরিব ছেলেকে ভালবাসে, সেদিন আমিও তাকে ইকবালের ও আমার ছেলেবেলার ঘটনা বলে বললাম, আমিও ইকবালকে ভীষণ ভালবাসি। তার কথা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ভুলতে পারব না। এরপর থেকে আসমা দাইহানের সঙ্গে যেদিন যা কথাবার্তা হত, স্কুলে এসে আমাকে বলত। হাফইয়ার্লি পরীক্ষার কয়েকদিন পর একদিন বলল, ইকবাল কয়েকটা বিষয়ে স্টারমার্ক পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে এস.এস.সি পাশ করে মা-বাবার খোঁজে এসেছে। কথাটা শোনার পর মনে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বললাম, তাকে বলবি, সে যেন কাল স্কুল ছুটির সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে। আসে। আসমা বলল, ঠিক আছে, স্কুল থেকে গিয়ে আজই বলব। পরের দিন স্কুলে। আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কিরে কথাটা ইকবালকে বলেছিলি? বলল, হ্যাঁ বলেছি। শুনে বলল, আমি হলাম তার বাবার দারোয়ানের ছেলে, দেখা করা কী ঠিক হবে? শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তার দু’দিন পর আসমা স্কুলে এসে বলল, ইকবাল ঢাকা চলে গেছে। আমি আসমাকে বললাম, ওর চাচাত ভাই দাইহানের কাছে ঢাকার। ঠিকানা দিয়ে গেছে কিনা জেনে, আমাকে জানাবি। পরের দিন বলল, ঠিকানা দিয়ে যাইনি। এস.এস.সি পাশ করার পর কলেজে পড়ার জন্য গোপালগঞ্জ চলে যাই। আর আসমার বিয়ে হয়ে যায় দাইহানের সঙ্গে। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমার কারণেই কাজেম চাচা ছেলের শোকে পাগল হয়ে মারা যায়। আর নাজমা চাচিও বিনা। চিকিৎসায় মারা যায়। তাদের এই পরিণতির জন্য সব সময় নিজেকে অপরাধী মনে। হয়।
তোমাকে যা কিছু বললাম, এসবের বেশিরভাগ দাদির কাছে শোনা। জান সুরাইয়া, আজ পর্যন্ত ইকবালকে মারার দৃশ্য ভুলতে পারিনি। যখন সেই দৃশ্য মনে পড়ে তখন খুব কষ্ট অনুভব করি, চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসে। তাই আমাকে কে যেন ঐ বাগানের দালানে টেনে নিয়ে যায়। আমার চোখ দেখে সবাই কম বেশি ভয় পায় বা অসন্তুষ্ট হয়; কিন্তু ইকবাল যখন আমার চোখ দেখেছিল তখন তাকে খুব খুশী হতে দেখেছিলাম। যদিও সে মাত্র একবারই দেখেছিল এবং আমরা দুজনেই তখন ছোট ছিলাম।
সুরাইয়া বলল, তুমি তো বললে, খুব ছোটবেলা থেকে আম্মা তোমাকে কালো চশমা পরিয়ে রাখতেন, ইকবাল তোমার চোখ দেখল কি করে?