সামসু ও জাবেদ দুটো ছাতা নিয়ে কাজেমের ঘরে এসে আমি আছি কিনা জিজ্ঞেস করল।
কাজেম বলল, না নেই। বিকেলে ইকবাল ও রুকসানা বাগানের ভিতরে খেলতে গিয়েছিল। মনে হয় ঝড় বৃষ্টিতে আসতে না পেরে দালানে রয়ে গেছে। আমি কয়েকবার যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঝড়ের দাপটে যেতে পারিনি। চল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।
তিনজনে এসে দেখল, আম গাছ পড়ে দালানের সামনেটা বন্ধ হয়ে গেছে। সামসু টর্চ লাইট জ্বেলে আমার ও ইকবালের নাম ধরে ডেকে বলল, তোমরা এখানে থাকলে বেরিয়ে এস, আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।
বেঞ্চের নিচে ঘাড় নিচু করে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল এবং ভয়ে ও ঠাণ্ডায় কাপছিলাম বলে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম। টর্চ লাইটের আলো দেখে ও সামসুর গলা পেয়ে আমি বললাম, আব্বা আমাদের খোঁজ করতে লোক পাঠিয়েছে।
ইকবালও তা বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে জোর গলায় বলল, হ্যাঁ, আমরা এখানে আছি। টর্চ লাইট এদিকে জ্বালিয়ে রাখুন। তারপর আমরা ডাল পালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলাম। তখনও আমরা ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম।
কাজেম চাচাও ইকবালকে তাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে সামসু ও জাবেদ আমাকে নিয়ে ফিরে এল।
ঘরের সবাই নিচের বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে রেগে গেলেও ঠাণ্ডায় কাঁপতে দেখে কিছু বলল না। শুধু দাদি আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে গা মুছিয়ে গরম তেল মালিশ করে দাও।
আম্মা আমার একটা হাত ধরে উপরের রুমে এনে প্রথমে কাপড় পাল্টে দিল। তারপর গায়ে তেল মালিশ করে দেওয়ার সময় যখন বুকের উপর হাত পড়ল তখন আমি হাত সরিয়ে দিয়ে উহ করে উঠলাম।
আম্মা আতঙ্কিতস্বরে বললেন, বুকে আঘাত পেয়েছিস নাকি?
আমি বললাম, না। ঝড় বৃষ্টি শুরু হতে আমরা দালানের বেঞ্চের নিচে ঢুকে গিয়েছিলাম। তারপর ঝাঁপটায় ভিজে গিয়ে ও ঠাণ্ডায় যখন কাপছিলাম তখন ইকবাল আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ আমার বুক টিপেছে। আমি নিষেধ করতে বলল, এটা করলে তোমার শীত কমে যাবে। তাই খুব ব্যথা হয়ে গেছে।
আমার কথা শুনে আম্মা খুব রেগে গিয়ে তেল মালিশ বন্ধ করে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমার তখন সেক্স সম্পর্কে কোনো জ্ঞান হয়নি। তাই আম্মার রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে বললাম, তুমি আমার দিকে অমন করে চেয়ে রয়েছ কেন? ভয় করছে তো?
আম্মা রাগ সামলে নিয়ে তেল মালিশ করতে করতে বলল, ইকবাল যে কতবড় অন্যায় করেছে তা বোঝার মতো বয়স তোর হয়নি। তোর আব্বাকে বলে এর বিহিত করতে বলব। তারপর তেল মালিশ শেষ করে এক গ্লাস গরম দুধ এনে আমাকে। খেতে দিয়ে চলে গেল।
ঐ রাত্রেই বোধ হয় আম্মা আব্বাকে কথাটা জানিয়েছিল। রাত্রের মধ্যেই ঝড় বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। পরেরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে আব্বাকে শঙ্কর মাছের চাবুক হাতে বেরিয়ে যেতে দেখে আমিও তার পিছু নিলাম। কেন জানি আমার মনে হল, আব্বা আমাকে দেখলে আসতে নিষেধ করবে। তাই ইকবালদের ঘরের অল্প দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম।
আব্বা কাজেম চাচার ঘরের কাছে এসে নাম ধরে ডাকল।
কাজেম চাচা ঘরের ভিতর ছেলেকে নিয়ে চা-মুড়ি খাচ্ছিল। আব্বার গলা পেয়ে। বেরিয়ে এসে তার হাতে শঙ্কর মাছের চাবুক দেখে ভয় পেল। চাকর-বাকর বা গ্রামের কেউ কোনো গুরুতর অন্যায় করলে সাহেব ও তার বাবাকে এই চাবুক ব্যবহার করতে দেখেছে। ভাবল, কালকের ঘটনায় ইকবালকে দোষী ভেবে কী শাসন করতে। এসেছে? কাচুমাচু হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
আব্বা গম্ভীর স্বরে ইকবালের কুকীর্তির কথা বলে বললেন, ওকে তুমি শাস্তি দিবে, না আমি দিব?
নাবালক ছেলের কুকীর্তির কথা শুনে খুব রেগে গেলেও শাস্তি দেওয়ার কথা শুনে ভয়ে কাজেম চাচার গলা শুকিয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর আমতা আমতা করে কোনো রকমে বলল, আপনি নিজের হাতে ওকে শাস্তি দিয়ে মেরে ফেলুন সাহেব। এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। কথা শেষ করে ঘর থেকে ইকবালকে টেনে হিঁচড়ে এনে আব্বার পায়ের কাছে ছেড়ে দিল।
আব্বা চাবুকটা কাজেম চাচার হাতে দিয়ে বলল, তোমার ছেলেকে তুমিই শাস্তি। দাও।
কাজেম চাচা এমন মার মারতে লাগল যে, মারের চোটে ইকবালের সমস্ত শরীর কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কাটা মুরগীর মতো মাটিতে গড়াতে গড়াতে। একসময় আজ্ঞান হয়ে নিথর হয়ে গেল।
আব্বা তার হাত থেকে চাবুকটা কেড়ে নিয়ে হনহন করে চলে এল।
গাছের আড়াল থেকে মারের দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গাছের তলায় পড়েছিলাম। ফেরার সময় আব্বা আমাকে গাছতলায় পড়ে থাকতে দেখে পাঁজাকোলা করে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। তারপর দাদিকে ও আম্মাকে ঘটনা বলে বলল, ইকবালের শাস্তি দেখে রুকসানা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর আম্মা মাথায় পানি ঢেলে আমার জ্ঞান ফেরায়।
আব্বা চলে আসার পর ইকবালের মা নাজমা চাচি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের অবস্থা দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে বলল, ছেলেমানুষী। খেয়ালে কি করেছে না করেছে, তাই বলে বাপ হয়ে এভাবে কেউ মারে। তুমি বাপ না দুষমন। ছেলের কিছু হলে আমিও বিষ খেয়ে মরব। তারপর ঘরে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে।