বেশ কিছুক্ষণ পর ইকবাল আসার সময় দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে পিছন থেকে এসে দু’হাতে আমার চোখ টিপে ধরল। ১. প্রথমে ভয় পেলেও হাতের উপর হাত রেখে বুঝতে পারলাম, ইকবাল। দেরি করে এসেছে বলে একটু রাগের সঙ্গে গাল ফুলিয়ে বললাম, যাও, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। সেই কখন থেকে দুটো পেয়ারা পেড়ে বসে আছি।
চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ইকবালও গাল ফুলিয়ে বলল, ঠিক আছে, তা হলে আমিও চলোম। কথা শেষ করে হাঁটতে শুরু করল।
আমি দৌড়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বললাম, তুমি দেরি করে এলে দোষ হল না। আর আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা। করছি বলতে দোষ হয়ে গেল?
আমার চোখের পানি দেখে ইকবালের রাগ পড়ে গেল। বলল, আজ দেরিতে স্কুলের ছুটি হয়েছে, সে কথা বলার আগেই তুমি আমার উপর রাগ করে কথা বললে। তাই আমিও রেগে গেলাম। কই আমার ভাগের পেয়ারাটা দাও।
ও যেমন একটুতেই রেগে যেত, তেমনি একটুতেই রাগ পড়ে যেত। আমি একটা পেয়ারা তার হাতে দিয়ে নিজেরটায় কামড় বসালাম। তুমিতো কখনো বাগান বাড়িতে যাও নি। বাগানের দক্ষিণ দিকে একটা বেশ বড় খাল আছে। পুরো বাগানটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। খালের দিকে বাগানের ভিতর আমাদের খেলার জায়গা। সেখানে তিন চারটে ঢালাইকরা পাকা বেঞ্চ ও একটা পাকা দালান আছে। দালানটার তিন দিকের দেওয়ালে তিনটে জানালা। কিন্তু সামনের দিকে দেওয়াল নেই। তিন দিকের দেওয়ালের গা ঘেঁষে পাকা বেঞ্চ। বাবা আমাকে যত রকমের খেলনা কিনে দিয়েছিলেন, সে সব আমি ঐ দালানে এনে রেখেছিলাম। ওর কোনো খেলনা ছিল না। ও বেড়ার ফাঁক গলে খালের কিনার থেকে কাদামাটি এনে আমার খেলনার মতো খেলনা বানাত। পেয়ারা খেতে খেতে দু’জনে দালানের কাছে এসে ইকবাল বলল, আজ একটা পালতোলা জাহাজ বানাব। যাও তোমার কাঠের জাহাজটা নিয়ে এস। তারপর বেড়ার ফাঁক গলে কাদা আনতে গেল।
আমার সব খেলনা দালানের একটা বেঞ্চের উপর সাজান থাকত। প্রতিদিন সেগুলো ঝেড়ে-পুছে রাখতাম। আমি সেগুলো ঝাড়ামোছা করছি। একটু পরে ইকবাল কাদা নিয়ে এসে বলল, ঝাড়ামোছা পরে করো আগে জাহাজটা দিয়ে যাও। আমি জাহাজটা নিয়ে তার কাছে বসলাম। ইকবাল সেটা দেখে দেখে জাহাজ বানাতে লাগল, আর আমি তাকে সাহায্য করতে লাগলাম।
আকাশে মেঘ করে অন্ধকার হয়ে এলে আমি বললাম, এই ইকবাল, এবার ঘরে যাই চল। কাল বানাবে। দেখছ না, মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে?
ইকবাল বলল, হোকগে, আর অল্প বাকি। এটুকু শেষ করে যাব।
তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুহূর্তের মধ্যে ভীষণ ঝড় উঠল। বাগানের অনেক গাছপালা মড় মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়তে লাগল। ইকবাল তাড়াতাড়ি আমার একটা হাত ধরে বেঞ্চের নিচে ঢুকে আমাকেও টেনে নিল। ঠিক সেই সময় একটা বড় আম গাছ উপড়ে দালানের সামনে পড়ল। তার ডালপালাতে দালানের মেঝে ঢেকে গেল। ইকবাল বলল, আর একটু হলে আমাদের ঘাড়ে পড়ত। এমন সময় কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়তে আমি ভয় পেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ইকবালও ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কেউ আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। আম গাছের ডালপালা থাকা সত্ত্বেও ঝাঁপটায় আমরা ভিজে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগলাম।
ইকবালদের ঘর বাগানের উত্তর পাশে। তার বাবা কাজেম চাচা জানে প্রতিদিনের মতো আজও ইকবাল বাগানের দালানে আমার সঙ্গে খেলতে গেছে। ঝড় শুরু হওয়ার পরও যখন সে ফিরল না তখন খুব চিন্তিত হল। ভাবল, হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হতে আমরা হয়তো দালানেই রয়ে গেছি। একটু কমলে গিয়ে নিয়ে আসবে। তবু আমার। কথা চিন্তা করে কয়েকবার হারিকেন নিয়ে বেরোবার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘর থেকে বেরোন মাত্রই প্রতিবারেই ঝড়বৃষ্টির দাপটে হারিকেন নিভে যায়। শেষে এশার নামায পড়ে স্বামী-স্ত্রী আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে।
এদিকে আম্মা জানে আমি বাগানে ইকবালের সঙ্গে খেলতে গেছি। ঝড় বৃষ্টি শুরু হল অথচ আমি ফিরলাম না দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। আব্বাকে কথাটা সাহস করে জানাতে না পেরে দাদিকে জানাল। দাদি আব্বাকে জানাল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে যখন ইকবালের সঙ্গে খেলা করতাম তখন আব্বা জানতে পেরে একদিন আম্মাকে রাগারাগি করে বলেছিল, আমাদের মেয়ে হয়ে চাকরের ছেলের সঙ্গে খেলাধুলা করা কি ঠিক হচ্ছে? লোক জানতে পারলে কী বলবে? আম্মা বলেছিল, এতে রাগ করছ কেন? রুকসানার চোখ খুব বড় বড় বলে, আমিই তাকে বাইরের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে দিইনি।ইকবাল চাকরের ছেলে হলে তো কি হয়েছে? ওরা বাগানের ভিতর খেলাধুলা করে। বাইরের লোকজন জানবে কেমন করে? সেখানে দাদি ছিলেন। তিনি বললেন, বৌমা ঠিক কথা বলেছে। তাছাড়া ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ফেরেস্তার মতো। চাকরের ছেলেকে ঘৃণা করা উচিত নয়। এরপর আব্বা আর কিছু বলেনি।
ঝড় বৃষ্টির দিনে আসার কথা দাদির মুখে শুনে আব্বা আতঙ্কিত স্বরে বললেন, সেকি? তারপর বললেন, ঝড় বৃষ্টির জন্য আসতে না পেরে ইকবালের সঙ্গে ওদের ঘরে উঠেছে মনে হয়।
দাদি বললেন, তবু তুই কাউকে কাজেমের ঘরে পাঠা।
সামসু ও জাবেদ নামে দুজন লোক বারমাস আমাদের বাড়িতে থেকে কাজ করত। আব্বা তাদেরকে পাঁচ ব্যাটারী টর্চ লাইট দিয়ে বললেন, তোমরা কাজেমের ঘরে যাও। সেখানে রুকসানা থাকলে নিয়ে আসবে।