হোসেন হাদিসে পড়েছে, “মুমীন বান্দা-বান্দীর মউতের সময় কপালে ঘাম দেয়। সেই সময় কাছে যে থাকবে সে কালেমা তৈয়েব ও কালেমা শাহাদাৎ শব্দ করে পড়বে। ভুলেও মুমূর্ষ ব্যক্তিকে কলেমা পড়ার জন্য তাগিদ দেবে না।” রুকসানার কপালে ঘাম দেখে হোসেনের হাদিসটা মনে পড়ল। রুমাল বার করে ঘাম মুছতে যাবে এমন সময় মালেকা এগিয়ে এসে বলল, আপনি সরে আসুন, যা করার আমি করছি।
এই কয়েকদিনে মালেকা যা অনুমান করেছে, এখানে এসে সবকিছু দেখেশুনে তা নিশ্চিত হয়েছে। সেও ঐ হাদিস জানে। আরো জানে স্যার যা করতে যাচ্ছেন, গায়ের মোহাররম লোক হিসাবে তা করা উচিত নয়। তাই তাকে সরে যেতে বলল।
মালেকার কথা শুনে হোসেনেরও কথাটা খেয়াল হল। রুমালটা তার হাতে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
মালেকা রুমাল দিয়ে রুকসানার ঘাম মুছে দেওয়ার সময় শব্দ করে কলেমা তৈয়েব ও কালেমা শাহাদাৎ পড়তে লাগল। তারপর চামচে পানি নিয়ে তার মুখে দিতে গেল।
ঠোঁটে চামচ ঠেকতে রুকসানা মালেকার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দু’তিন চামচ পানি খেল। তারপর ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করার সময় মাথাটা একপাশে কাৎ হয়ে গেল।
রুকসানা মারা গেছে বুঝতে পেরে মালেকা ভিজে গলায় “ইন্নালিল্লাহে—– রাজেউন” পড়ে বলল, উনি ইন্তেকাল করেছেন।
হোসেন কিছুক্ষণ রুকসানার নাড়ী ধরে পরীক্ষা করল। তারপর নিশ্চিত হয়ে ইন্নালিল্লাহে— রাজেউন পড়ে যখন গায়ের চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিচ্ছিল তখন তার চোখের পানি টপ টপ করে রুকসানার বুকের উপর পড়তে লাগল।
অন্য সবাই বুঝে উঠার আগেই আব্দুর রশিদের সঙ্গে ডাক্তার এসে ভীড় দেখে রাগের সঙ্গে বললেন, নিষেধ করা সত্ত্বেও আপনারা এসেছেন? যান শিগগির বেরিয়ে যান। আব্দুল মতিনকে দেখতে পেয়ে বললেন, ঠিক আছে, আপনি থাকুন। তারপর বেডের কাছে এগিয়ে এলে হোসেন বলল, পরীক্ষা করার দরকার নেই, সী ইজ ডেড।
ডাক্তার তার কথায় কান না দিয়ে চাদর সরাবার জন্য হাত বাড়ালেন।
হোসেন হাতটা ধরে ফেলে বলল, প্লিজ ডক্টর, ডোন্ট টাচ দা ডেডবডি।
ডাক্তার রেগে উঠে বললেন, হাত ছাড়ন, আমাকে আমার কর্তব্য করতে দিন।
হোসেন এবার তার দুটো হাত ধরে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, বিলীভ মী, আই এম অলসো এ ডক্টর। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছল।
হোসেনের কথা শুনে ও তার চোখে পানি দেখে ডাক্তারের রাগ পড়ে গেল। বললেন, এক্সট্রমলি সরি। প্লিজ, এক্সকিউজ মী।
একটা অনুরোধ করব রাখতেই হবে।
বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
পোষ্টমর্টম না করে ডেডবডি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
তা কি করে সম্ভব? ডাক্তার হিসাবে আপনিও তো হাসপাতালের নিয়ম কানুন জানেন।
জানি। আর এটাও জানি, ক্ষেত্র বিশেষে সব আইনের ব্যতিক্রম আছে। আমার মতে এরকম ক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের পোস্টমটম না করে লাশ দিয়ে দেওয়াই উচিত। শুধু শুধু মেয়েদের লাশের বেইজ্জতী করা ঠিক নয়।
আপনার সঙ্গে আমিও একমত। ঠিক আছে, আমি সেই ব্যবস্থা করছি। আপনি একটু পরে আমার রুমে আসুন। কথা শেষ করে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।
কেবিনে ঢোকার পর থেকে হোসেনের ও মালেকার কাজ-কর্ম ও কথা-বার্তা শুনে সবাই এত অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, তারা যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সকলের হুশ হল। মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আসমা রুকসানার লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সই, তুই আমাকে মাফ করে দে, আমি তোর জন্যে কিছুই করতে পারলাম না।
হোসেন দাইহানকে বলল, ওকে সরিয়ে নাও। তারপর আসমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কী হাদিসে পড়নি? আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “উচ্চস্বরে যাহার জন্য বিলাপ করা হয়, বিচার দিবসে তাহার দ্বারা তাহাকে শাস্তি দেওয়া হউবে।” [বর্ণনায় : হযরত মুগীরাহ বিন শোবাহ (রাঃ) বুখারী মুসলিম]
তিন ভাই আব্বাকে ধরে কাঁদছিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, বড় আপা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল আব্বা। তারপর আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আব্দুল মতিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমাদের বড় আপা তোমাদেরকে ছেড়ে যায়নি, আমিই তাকে থাকতে দিলাম না। তোমরা আমাকে মাফ করে দাও। তারপর মেয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহ আমাকে মাফ করবে কিনা জানি না, তুই আমাকে মাফ করে দে মা। এই কথা বলে ছেলেদের গায়ের উপর এলিয়ে পড়লেন।
আব্দুর রশিদ আব্বা আব্বা বলে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে অন্য দু’ভাইকে বলল, আব্বা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর ধরাধরি করে অন্য বেডে শুইয়ে দিল। হোসেন এগিয়ে এসে নাড়ি ধরে বলল, হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আপনাদের কেউ একজন গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসুন।