আসমা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে করতে চাচার কোলে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কাদল। তারপর বাথরুম থেকে রক্তধুয়ে এসে বলল, আপনার কাপড়ে রক্ত লেগে গেছে, পাল্টাতে হবে।
আব্দুল মতিন বললেন, লাগুক। তুমি করিমনকে ডেকে নিয়ে এস।
করিমন অল্প দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। শুনতে পেয়ে এগিয়ে এল।
তাকে দেখে আব্দুল মতিন বললেন, সামসুকে একটা স্কুটার ডেকে নিয়ে আসতে বল।
আসমা বলল, আমরা স্কুটার নিয়ে এসেছি। তারপর করিমনকে বলল, ইব্রাহিমের আব্বা নিচে বসে আছেন, তাকে ডেকে নিয়ে এস। চাচাকে ধরে নিয়ে যাবে।
.
হোসেন মালেকা ও তার মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে বারান্দায় পাঁচ ছয়জন মেয়ে-পুরুষকে নীরবে কাঁদতে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে এসে আব্দুর রসিদকে চিনতে পেরে সালাম দিল।
আব্দুর রশিদ ও হোসেনকে চিনতে পারল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আসমা আপা কী আব্বাকে আনতে গেছে?
হ্যাঁ বলে হোসেন জিজ্ঞেস করল, রুকসানা কেমন আছে?
আব্দুর রশিদ বলল, ভালো না। ডাক্তার আমাদেরকে বার করে দিয়েছে। সূরাইয়া ও আম্মা আছেন। তারপর খালেক ও বোরখা পরা মালেকা ও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ইনারা?
হোসেন বলল, ঢাকা থেকে এসেছেন। ইনাদের কাছে থেকে আমি মানুষ হয়েছি।
আব্দুর রশিদ খালেকের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আপনারা এখানেই থাকুন। ডাক্তার কাউকেই ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না। তারপর হোসেনকে বলল, আসুন। আমার সঙ্গে। যেতে যেতে বলল, বড় আপাকে কেবিনে রাখা হয়েছে। মেয়েরা কান্নাকাটি করছিল, তাই ডাক্তার বার করে দিয়েছেন।
ডাক্তার রুকসানাকে ইঞ্জেকসান দিয়ে অবজার্ভ করছিলেন। আব্দুর রশিদ ও ইকবালকে ঢুকতে দেখে বিরক্ত প্রকাশ করে হাত দিয়ে ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বললেন।
আব্দুর রশিদ কাছে এসে হোসেনকে দেখিয়ে বলল, আপনি যাকে নিয়ে আসতে বলেছিলেন, উনি সেই।
ডাক্তার এগিয়ে এলে ইকবাল সালাম দিল।
ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন। আপনি এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। পেসেন্টের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আপনার নাম বার বার বলছিলেন। আর খুব অস্থিরতা অনুভব করছিলেন। তাই কিছুক্ষণ আগে ইঞ্জেকশান দিয়েছি। ঘণ্টা খানেক ঘুমাবেন। তবে তার আগেও ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। আপনি এখানেই থাকুন, কোথাও যাবেন না। ঘুম ভাঙ্গার পর আপনাকে দেখে পেসেন্টের অবস্থা ভালো-মন্দ দুটোই হতে পারে। আশা করি, ভালই হবে। আর যদি মন্দ কিছুর লক্ষণ দেখা যায়, আমাকে খবর দেবেন। তারপর আজিজা বেগম ও সুরাইয়াকে দেখিয়ে আব্দুর রশিদকে বললেন, ইনাদেরকে নিয়ে আপনি বাইরে থাকুন। কথা শেষ করে নার্সকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আজিজা বেগম হোসেনকে চিনতে না পারলেও ছেলের কথা শুনে বুঝতে পারলেন এই সেই ইকবাল।
ডাক্তার বেরিয়ে যাওয়ার পর আব্দুর রশিদ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়াল।
অন্যরা দেখতে পেয়ে তাদের কাছে এল।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর রুকসানার দিকে তাকিয়ে হোসেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। মুখটা ছাড়া সারা শরীর চাঁদরে ঢাকা। তবু তার মনে হল শরীরে এতটুকু মাংস নেই। হাড়ের সঙ্গে শুধু চামড়া লেগে রয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছে সংযত হওয়ার চেষ্টা করল।
ঠিক আধ ঘণ্টা পর রুকসানা একটু নড়ে উঠে চোখ মেলে তাকাল। হোসেনকে দেখে চমকে উঠে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চারপাশে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। অল্পক্ষণ পর আবার চোখ মেলে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল; কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বার হল না। দু’চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। আর সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
হোসেন বুঝতে পারল, রুকসানা তাকে দেখে এত খুশী হয়েছে যে, কথা বলতে পারছে না। বলল, বিশ্বাস কর রুকসানা, তোমার অবস্থা যে এ রকম হয়েছে তা জানতাম না। এই কথা বলার পর তাকে আরো বেশি কাঁপতে দেখে বিপদ হতে পারে ভেবে ডাক্তারকে খবর জানাবার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।
সবেমাত্র আব্দুল মতিন আসমা ও দাইহানের সঙ্গে এসে আব্দুর রশিদকে। রুকসানার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। হোসেন স্যারকে দেখে সকলের সঙ্গে তিনিও তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
হোসেন আব্দুল মতিনের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে আব্দুর রশিদকে বলল, শিগগির ডাক্তার নিয়ে আসুন, রুকসানা কেমন করছে। তারপর রুকসানার কাছে ফিরে এল।
আব্দুর রশিদ তাড়াতাড়ি করে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য চলে গেল। আর ওরা সবাই ঢুকে রুকসানার বেডের কাছে এসে দাঁড়াল।
রুকসানা তখনও হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সবাই আসার পর তাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘন ঘন মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগল। আর খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।
হোসেন বলল, তুমি এরকম করছ কেন রুকসানা? প্লিজ, শান্ত হও। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার কাছে থাকব। দেখ না, আসমা ও দাইহান ভাই তোমার আব্বাকে নিয়ে এসেছে। বাড়ির অন্যান্য সকলে ও আমি ঢাকায় যাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছি, তারাও এসেছেন।
হোসেনের কথা শুনে রুকসানা আর একবার সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে শান্ত হল। সেই সাথে তার কপালে ঘাম দেখা দিল।