চিঠি পড়ে আসমা যখন হোসেনকে ডেকে নিয়ে আসার কথা দাইহানকে বলে তখন থেকে মালেকা চিন্তা করছিল, আসমার সই-এর অসুখ, সে দেখতে যাবে; কিন্তু স্যারকে ডেকে পাঠাল কেন? তারপর চিঠি পড়ে স্যারের চোখে পানি দেখে আসমার সই-ই স্যারের ভালোবাসার পাত্রী হোসেনের কথার উত্তরে বলল, হ্যাঁ যাব, চলুন।
সবকিছু দেখে শুনে খালেকেরও কেমন যেন সন্দেহ হল। ভাবল, তাহলে কি এই মেয়ের জন্য হোসেন এখনও বিয়ে করেনি? মেয়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল, চল মা, আমরাও তোদের সঙ্গে যাব।
.
আসমা ও দাইহান বড় রাস্তায় এসে একটা স্কুটার নিয়ে বাহিরবাগ এল। আসমা স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসতে বলে উপরে এসে দেখল, চাচা বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে আছেন। কাছে এসে সালাম দিল।
আব্দুল মতিন চৌধুরীর আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। তার উপর রুকসানা তাদের দারোয়ানের চরিত্রহীন ছেলেকে ভালবেসে এতদিন বিয়ে করতে চায়নি জানার পর থেকে মেয়ের উপর ভীষণ রেগে আছেন। তাই সে যতদিন ঘরে শয্যাশায়ী ছিল, একদিনও তার কাছে যায়নি। এমন কি কারো কাছে তার ভালো-মন্দ জিজ্ঞেসও করেন নি। মেয়ের অবস্থার অবনতি জেনে সবাই হাসপাতালে গেলেও তিনি যাননি। কিছুক্ষণ আগে স্ত্রীও ছোট ছেলে এসে ডাক্তারের কথা বলে নিয়ে যেতে চাইলেও যাননি। এখন আসমা ও দাইহানকে উঠোন পার হয়ে আসতে দেখে ভাবলেন, মেয়েটা বুঝি শেষ পর্যন্ত মরেই গেল। নিজের অজান্তে চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। হাজার হোক বাবা তো। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেললেন। আসমা সালাম দিতে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিয়ে বললেন, কেন এসেছ?
আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সই-এর অবস্থা খুব খারাপ।
আব্দুল মতিন গর্জন করে উঠলেন, যে মেয়ের আত্মমর্যাদাবোধ নেই, যে মেয়ে বংশের মান-সম্মান ডুবিয়ে দিতে চায়, সে মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তুমি চলে যাও, আমি যাব না।
আব্দুল মতিনের দু’পা জড়িয়ে ধরে আসমা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, তাহলে আপনি কেন আমার আব্বার মান-সম্মান ডুবিয়ে দিয়ে একটা কামলার ছেলে কামলা, যে নাকি আমাদের কামলা ছিল, তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন? আমি আপনার মেয়ের সই, আমাকে বাঁচাতে পারলেন অথচ নিজের মেয়েকে পারছেন না কেন? সন্তানের চেয়ে আপনার আত্মমর্যাদা ও বংশের মান-সম্মান বড় হল?
আব্দুল মতিন রাগের সঙ্গেই বললেন, শুধু মান-সম্মান ও বংশ মর্যাদাই নয়, এমন আরো একটা কারণ আছে, যা তুমি জানলে তার জন্য সুপারিশ করতে আসতে না।
আসমা বলল, কারণটা আমি জানতে চাই।
সে একটা চরিত্রহীন লম্পট ছেলে। জেনেশুনে তাকে জামাই করতে পারি না।
এবার আসমা রেগে উঠে বলল, হোসেন ভাইকে আপনি কতটা চেনেন জানি না। আমরা তো জানি, তার মতো চরিত্রবান ছেলে এ যুগে বিরল।
আব্দুল মতিন বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তোমরা তার বর্তমান দেখেছ, অতীতটা দেখনি।
চাচার কথা শুনে আসমা অনুমান করে বলল, আপনি কী সেই ছেলেবেলার ঘটনার জন্য তাকে চরিত্রহীন বলছেন? তাই যদি হয়, বলব, আপনি বিরাট ভুল করছেন।
আব্দুল মতিন কুচকে বললেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?
আসমা বলল, তখন যা ঘটেছিল সেটা যে অন্যায়, তা বোঝার মতো বয়স তাদের কারই হয়নি। তবু হোসেন ভাই শাস্তি পেয়েছিল। আমি যতটুকু জানি, ঐ শাস্তির কারণেই সেই সময় হোসেন ভাই রুকসানাকে বিয়ে করার প্রতিজ্ঞা করে তার উপযুক্ত হওয়ার জন্য পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আসমা আবার বলল, সে যদি চরিত্রহীন হত, তাহলে ঢাকায় কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক কিছু করতে পারত। তাছাড়াও আমেরিকায় দীর্ঘ দশ বছর চাকরি করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছে। সেখানেও ফুর্তি-আমোদ করে টাকা নষ্ট করে ফেলতে পারত। অথবা বিয়ে করে সেখানে থেকে যেতেও পারত। কিন্তু সেসব কিছু না করে রুকসানার উপযুক্ত হয়ে তারই জন্য গ্রামে ফিরে এসেছে। তারপরও আপনাদের মান সম্মান ও বংশ গৌরবের কথা চিন্তা করে আত্মগোপন করেছিল। এমন কি সই-এর কাছেও। ষাড়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় উভয়কে চিনতে পারে এবং একে অপরের মনের কথা জানতে পারে। তবু তারা দুজনে আপনার কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরে ছিল। সুরাইয়া ভাবি ও আপনার মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল, সেসব শুনেই সই এর এই পরিনতি। এই পর্যন্ত বলে আসমা চাচার চোখের দিকে চেয়ে বলল, সই তো আপনারই মেয়ে। সে একটা চরিত্রহীন ছেলেকে ভালবেসে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে, একথা ভাবলেন কী করে?
আসমার কথা শুনে আব্দুল মতিনের ভুল ভাঙ্গল। কিন্তু তা স্বীকার করতে না পেরে চুপ করে রইলেন।
আসমা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ডাক্তার যে কথা বলেছেন, তা বলে বলল, এরপরও যদি আপনি হাসপাতালে গিয়ে সইকে বাঁচাতে না চান, তাহলে আপনার সামনেই মাথা ঠুকে জান দিয়ে দেব। এই কথা বলে মেঝেয় মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমি আত্মঘাতী হব জেনে আমাকে রক্ষা করেছিলেন। এখন সইকে বাঁচাবার জন্য আপনার সামনেই আত্মঘাতী হব। দেখব, আপনার ভুল ধারণাটাই বড়, না। আমার ও আমার সই-এর জীবন বড়? বারবার পাকা মেঝেয় মাথা ঠুকার ফলে আসমার কপাল কেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তাকে মাথা ঠুকতে ও তার রক্তাক্ত মুখ দেখে আব্দুল মতিন স্থির থাকতে পারলেন না। এক হাতে মাথা ধরে কোলে টেনে নিয়ে ভিজে গলায় বললেন, তুমি আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছ মা। আমি তোমার সব কথা মেনে নিচ্ছি। আমাকে রুকসানার কাছে নিয়ে চল।