রাত্রে খাওয়ার পর মালেকা গল্প করার কথা বলতে পারে ভেবে আসমা যয়নাবের শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ঘরে চলে গেল।
পরের দিন আসমা এক ফাঁকে হোসেনকে বলল, মালেকা আপার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি, উনি এখনও বিয়ে করেন নি। কেন করেন নি তুমি জান?
হোসেন বলল, আমি জানব কি করে? তাকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।
জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, দুঃখিত, বলতে পারব না। আমার মনে হয় তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাই বিয়ে না করে আজও তোমার প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
এখন এসব কথা আলাপ করার সময় নেই বলে হোসেন তার কাছে থেকে চলে গেল।
আসমা তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। হোসেন ভাই নিশ্চয় মালেকা আপার মনের কথা জানে।
.
আজ হাসপাতাল উদ্বোধন হবে। সকাল থেকে হোসেন খুব ব্যস্ত। বেলা দশটার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে এসে গেলেন। এগারটার সময় তিনি ফিতে কেটে হাসপাতাল উদ্বোধন করলেন।
দাইহান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসার সময় আসমা, মালেকা ও তার মা-বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
কুরআন তেলাওয়াতের পর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বক্তৃতা দিলেন। সব শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতাল চালু রাখার কর্মসূচীর ব্যাপারে বক্তৃতা দিয়ে বললেন, এই হাসপাতাল যাতে সরকারী অনুমোদিত হয় এবং অনুদান পায়, সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় করব। তারপর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আরো অনেক কিছু বলে অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণার পর আসমা ও মেহমানদেরকে দাইহান ঘরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। তারা বড় রাস্তায় উঠেছে, এমন সময় একটা লোক রিকশা থেকে। নেমে একটা ভাঁজ করা কাগজের উপর লেখা ঠিকানা দেখিয়ে দাইহানকে বলল, এই মহিলার বাড়িটা দেখিয়ে দিন তো।
কাগজটায় আসমার নাম ঠিকানা দেখে দাইহান জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
গোপালগঞ্জ হাসপাতাল থেকে।
দাইহান বলল, এটা আমার স্ত্রীর নাম। তারপর কাগজটা আসমার হাতে দিল।
লোকটা বিদায় নিয়ে ঐ রিকশাতেই চলে গেল।
আসমা কাগজটা খুলে পড়ে স্বামীকে বলল, সুরাইয়া ভাবি চিঠি দিয়েছেন। সই-এর অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে। তুমি হোসেন ভাইকে ডেবে নিয়ে এস। আমি ইনাদের নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।
হোসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বিদায় করে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছিল।
দাইহান এসে তাকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে আসমার কথাগুলো বলল।
হোসেন শুনে চমকে উঠল। তারপর কমিটির সদস্যদের কাছে ফিরে এসে বলল, বিশেষ প্রয়োজনে ঘরে যেতে হচ্ছে। পরে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করব। তারপর সালাম বিনিময় করে দাইহানের সঙ্গে ঘরে এল।
আসমা চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, হাসপাতাল থেকে সুরাইয়া ভাবি পাঠিয়েছেন। পড়ে দেখ।
হোসেন পড়তে শুরু করল,
আসমা আপা,
সালামান্তে জানাই যে, বড় আপার অবস্থার অবনতি জেনে আমরা সবাই এসেছি। শুধু আব্বা আসেননি। এখানে আসার পর আমরা ডাক্তারকে বললাম, রুগীকে ঢাকায় নিয়ে যাব। ডাক্তার বললেন, “কোনো লাভ হবে না। রুগী ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। আপনারা নিশ্চয় কারণটা জানেন। তা যদি বলেন, তাহলে বাঁচাব চেষ্টা করতে পারি।” আমি তোমার ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে সেই ছোটবেলার ঘটনা থেকে শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে ডাক্তার বললেন, “কথাটা চেপে রেখে আপনারা খুবই অন্যায় করেছেন। আমরা এতদিন যত চিকিৎসা করেছি, সব ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। যা বলছি শুনুন, আপনারা রুগীর বাবাকে ও সেই ছেলেকে অতি সত্বর নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আল্লাহ যদি ওঁর হায়াত রেখে থাকেন, তাহলে ওদেরকে কাছে পেলে রুগীর মানসিক যন্ত্রণা কমবে এবং আমাদের চিকিৎসায় কাজও হবে।” ডাক্তারের কথা শোনার পর আমরা আম্মাও আব্দুল করিমকে আব্বাকে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়েছিলাম, উনি আসেন নি। বড় আপা হোসেন স্যারকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। তাকে ডেকে আনার জন্য বার বার তাগিদ দিচ্ছে। বলছে “আমি আর বাঁচব না। শেষ বারের মতো একবার তাকে দেখতে চাই।” চিঠি পাওয়া মাত্র আপনি তাকে নিয়ে আসবেন। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।
ইতি
আপনার সুরাইয়া ভাবি
চিঠি পড়ে হোসেনের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আসমার দিকে তাকাল।
আসমা বলল, আমি তোমার ভাইকে নিয়ে বাহিরবাগ যাচ্ছি। চাচাকে যেমন করে হোক হাসপাতালে নিয়ে আসব। তুমি মালেকা আপাকে নিয়ে যাও। তারপর মালেকাকে বলল, আপনি যাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে গেলে তাদের সঙ্গে দেখা হবে।
আসমার কথা শুনে হোসেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আসমা বলল, হোসেন ভাই, আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছ তাই না? পরে সব কিছু বলব, এখন ওঁকে নিয়ে রওয়ানা দাও। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে চল আমরা যাই বলে হাঁটতে শুরু করল।
চিঠি পাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত খালেক সবকিছু লক্ষ্য করছে। দাইহান ও আসমা চলে যাওয়ার পর হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার বলতো বাবা, তোমাদেরকে খুব পেরেশান দেখাচ্ছে? হাসপাতালে কে আছে?
হোসেন বলল, বাহিরবাগের চৌধুরীদের মেয়ে রুকসানা আসমার সই। সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। এখন তার অবস্থা খুব খারাপ। তারপর মালেকার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী যাবে?