আসমা বলল, সবর করুন সুরাইয়া ভাবি। তকদিরে যা লেখা আছে, তা যে কোনো অসিলায় হবেই। আজ আর চাচা-চাচির সাথে দেখা করব না। ঢাকা থেকে হোসেন ভাইয়ের বাড়িতে তিনজন মেহমান এসেছেন। আমাকেই সবকিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে। পরশু হাসপাতাল উদ্বোধন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসবেন। হোসেন ভাইও খুব ব্যস্ত। ইনশাআল্লাহ উদ্বোধনের পরের দিন এসে চাচার হাতে পায়ে ধরে রাজি করাব। এখন যাই, সইকে হাসপাতালে দেখে বাড়ি যাব।
এমন সময় করিমন নাস্তা নিয়ে এলে সুরাইয়া বলল, একটু মুখে দিয়ে যান।
নাস্তা খেয়ে আসমা বিদায় নিয়ে নিচে এসে স্বামীকে বলল, সই গোপালগঞ্জ হাসপাতালে। চল, তাকে দেখে তারপর ফিরব।
হাসপাতালে এসে রুকসানাকে দেখে আসমা ও দাইহান চোখের পানি রোধ করতে পারল না। বেডে যেন একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। আসমা সেই কঙ্কালকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এ তোর কি হাল হয়েছে সই? কাউকে দিয়ে আমাকে একটা খবরও দিলি না? তারপর ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আল্লাহগো, তুমি আমার সই-এর উপর রহম কর।
একজন নার্স দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে আসমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাগের সঙ্গে বললেন, এ কী করছেন আপনি? রুগীর অবস্থা খুব খারাপ। একটু উত্তেজিত হলে হার্টফেল করবেন। যান, চলে যান এখান থেকে।
রুকসানা ক্ষীণ স্বরে নার্সকে বলল, সিস্টার ওকে থাকতে দিন। চলে গেলেই বরং আমি হার্টফেল করব। আপনি যান, ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলব।
নার্স বলল, কিন্তু স্যারের অর্ডার, কেউ যেন আপনাকে এতটুকু ডিস্টার্ব না করে।
রুকসানা বলল ও তো ডিস্টার্ব করছে না, বরং ওকে দেখে বেশ সুস্থ বোধ করছি। প্লিজ, আপনি একটু যান।
নার্স বিরক্ত হয়ে চলে গেল।
রুকসানা দাইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,তোমাদের হাসপাতাল উদ্বোধন হয়ে গেছে?
না বড় আপা, পরশু হবে। তারপর ভিজে গলায় বলল, বড় আপা, আপনার অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাদের যে উপকার করেছেন, আজীবন ভুলতে পারব না। সব থেকে বড় দুঃখ, আমরা আপনার কোনো উপকার করতে। পারলাম না। কথা শেষ করে চোখ মুছল।
সুরাইয়া বলল, তোমরা অত বিচলিত হচ্ছ কেন? জান না, সারা বিশ্ব জগতে যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহপাকের ইশারাতেই হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। দুঃখ করো না দাইহান ভাই, আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নেওয়াই প্রকৃত মুমীনের লক্ষণ। তারপর আসমাকে বলল, সই, তোরা আমার জন্য দোয়া করিম, “আল্লাহ যেন ঈমানের সঙ্গে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন।” আর হোসেনকে বলবি, হাসপাতাল উদ্বোধনের পরের দিন যেন অতি অবশ্যই আসে। তোরাও আসবি। শেষ বারের মতো তোদের সবাইকে একবার দেখতে চাই। দুনিয়াতে বোধ হয় আমাদের মিলন আল্লাহর ইচ্ছা নয়। তাই আমাকে তুলে নিচ্ছেন। অনেকবার ভেবেছি, গোপনে হোসেনের কাছে গিয়ে বলব, চল, আমরা বিয়ে করে আমেরিকা চলে যাই। কিন্তু আব্বার কথা ভেবে তা না করে সবর করেছি।
এমন সময় নার্সের কাছে খবর পেয়ে ডাক্তার এসে আসমা ও দাইহানকে একপাশে ডেকে নিয়ে এমন কিছু কথা বললেন, যা শুনে তারা এক্ষুনি চলে যেতে রাজি হল। তারপর আসমা একা এসে বলল, সই, কিছু মনে করিস নি, তোর ভালোর জন্যে চলে যেতে হচ্ছে। এই কথা বলে চোখ মুছতে মুছতে স্বামীর কাছে এসে বলল, চল।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসমা যখন হোসেনের ঘরে এল তখন সে রুগীদের ওষুধ দিচ্ছিল। তাকে দেখে হোসেন রুগীদের একটু বসতে বলে আসমার কাছে এসে বলল, রুকসানার খবর কি বল।
আসমা বলল, তোমার ঘরে চল।
ঘরে এসে তাকে বসতে বলে নিজেও বসল।
আসমা বসে বলল, সই-এর অবস্থা খুব খারাপ। গতকাল গোপালগঞ্জের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি বাহিরবাগে গিয়ে সেকথা জেনে হাসপাতালে সইকে দেখে এসেছি। তারপর সুরাইয়া ভাবি ও রুকসানা যা কিছু বলেছে, তা বলে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আল্লাহ না করুক, আমার মনে হচ্ছে, সই বেশি দিন বাঁচবে না।
আসমার কথা শুনে ইকবালের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, কেঁদে কী হবে? রুকসানা ঠিক কথা বলেছে, “সারা বিশ্ব জগতে যা কিছু ঘটছে, আল্লাহর ইশারাতেই ঘটছে। কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না।” আমারও মনে হচ্ছে দুনিয়াতে আমাদের মিলন আল্লাহর ইচ্ছা নয়। এখন যাই, রুগীরা বসে আছে বলে ইকবাল চলে গেল।
.
আজ সকাল থেকে আসমাকে না দেখে মালেকা বুঝতে পারল, সে বাহিরবাগ গেছে। দুপুরে খাওয়ার পর সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন মালেকা বিছানায় শুয়ে চিন্তা করছিল, স্যার যখন আমাদের বাড়িতে যায় তখন সেভেনে পড়তেন। সে সময় তার বয়সই বা কত ছিল? বড় জোর তের চৌদ্দ। আর মেয়েটিরও হয়তো তাই অথবা দু’এক বছর কম। অত ছোটবেলার ভালবাসা দীর্ঘ বিশ-একুশ বছর যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও এত গম্ভীর হল কি করে? যদি আসমার কথা সত্য হয়, তাহলে এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। এই সব চিন্তা করতে করতে শুয়ে থাকতে ভালো লাগল না। উঠে হোসেনের ঘরে গেল। ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, বুকসেলফের বইগুলো এলোমেলো। টেবিলের উপরেও কয়েকটা বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, আলনার জামা-কাপড়গুলোর অবস্থাও ঐ একই রকম। বিছানার চাদর অর্ধেক গুটান, বালিশ দুটো জায়গামতো নেই। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে সবকিছু গুছাল। তারপর ঘরে ঝাট দেবে বলে ঝাটার খোঁজ করল। না পেয়ে বাইরে এসে রান্না ঘরের বেড়ায় ঠেস দেওয়া একটা ঝাটা দেখতে পেয়ে সেখানে গেল। এমন সময় আসমাকে ডিসপেন্সারীর দরজার বাইরে থেকে স্যারকে পাশের ঘরে যাওয়ার কথা বলতে শুনে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তাদেরকে ঘরে ঢুকে যেতে দেখে পিছনের দিকের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। তাদের কথা-বার্তা শুনে যখন বুঝতে পারল, আসমার সই-ই স্যারের প্রেমিকা তখন সেখান থেকে চলে এল।