ওর পুরো নাম ইকবাল হোসেন। এখানে হোসেন নামেই পরিচিত।
আপনারা তো স্যারের নিকট আত্মীয়, তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কিছু বলেন নি?
আসমা গ্রামের মেয়ে। তার ধারণা নেই, শহরের শিক্ষিত মেয়েদের পঁচিশ ত্রিশ বছরের আগে বিয়ে হয় না। তাই মালেকাকে বিবাহিত মনে করে বললেন, হোসেন ভাই ঢাকায় যাওয়ার আগে কিশোর বয়সেই একটা মেয়েকে ভালবাসত। সেই মেয়েটাও হোসেন ভাইকে ভালবাসত। তার কথা আজও ভুলতে পারেনি। তাই বিয়ে করেনি।
মালেকা খুব অবাক হয়ে বলল, সে তো ছোটবেলার ঘটনা। মেয়েটি নিশ্চয় এতদিনে স্বামী ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছে?
আপনার ধারণা ভুল। মেয়েটিও একই কারণে এখনও বিয়ে করেনি।
মালেকা আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, তা কি করে সম্ভব। আমি যতদূর জানি, স্যার ঢাকায় যাওয়ার পর একেবারে এস.এস.সি পাশ করে চার-পাঁচ বছর পর গ্রামে মাত্র একবার এসে তিন চার দিন ছিলেন। তারপর প্রায় পনের ষোল বছর পর গ্রামে এসেছেন। এরমধ্যে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি করে ভাবতে খুব অবাক লাগছে।
আসমা মৃদু হেসে বলল, শুনলে আরো অবাক হবেন, হোসেন ভাই ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে তিন চার মাস আগে পর্যন্ত তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া তো দূরের কথা, চিঠি-পত্রও আদান-প্রদান হয়নি এবং দু’জনেই একে অপরকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে ভাবত।
মালেকা বলল, সত্যিই এটা একটা অকল্পনীয় ঘটনা। তারপর বলল, আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে, এখন দেখা-সাক্ষাৎ হয় এবং একে অপরের বিয়ে না করার কারণও নিশ্চয় জেনেছেন?
হ্যাঁ জেনেছে।
তা হলে বিয়ে করছেন না কেন?
কারণ তারা দু’জনেই জানে, বিয়ে হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কেন?
দুঃখিত, এর থেকে আর বেশি কিছু বলতে পারব না।
মালেকা খুব আশ্চর্য হয়ে আসমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মেয়েটির বাড়ি কোথায় বলতে নিশ্চয় বাধা নেই?
না, তা নেই।
তা হলে বলুন।
এই গ্রাম থেকে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার পূর্ব দিকে বাহিরবাগ গ্রামে।
আপনি যখন এতকিছু জানেন তখন মেয়েটির মা-বাবাকে নিশ্চয় চেনেন?
হ্যাঁ, তাদের সবাইকে চিনি।
আমরা এক সপ্তাহ থাকব। আমি মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। তবে স্যার যেন জানতে না পারেন। আপনি কী এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন?
আসমার সন্দেহ হল। ভাবল, মালেকা এতকিছু জানতে চাচ্ছে কেন? কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এক্ষুনি কথা দিতে পারছি না। আপনি তো কয়েকদিন থাকবেন বললেন, আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে জানাব। এবার আমি দু’একটা প্রশ্ন করব। কিছু মনে করতে পারবেন না কিন্তু।
বেশ তো কি জানতে চান বলুন।
আপনি অধ্যাপনা করেন, আপনার স্বামী কি করেন?
মালেকা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আব্বা-আম্মা বিয়ে দিতে চেয়েছেন, আমি রাজি হইনি।
আসমার সন্দেহটা বেড়ে গেল। বলল, কেন রাজি হননি বলবেন?
দুঃখিত বলতে পারব না।
যদি বলি আপনার কথা-বার্তায় বোঝা যাচ্ছে, আপনি হোসেন ভাইকে ভালবাসেন। তাই বিয়ে করেন নি; তাহলে কী অস্বীকার করবেন?
মালেকা কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আসমা বলল, কিছু বলছেন না যে?
আপনি শিক্ষিতা, জিজ্ঞেস না করে বুঝে নেওয়া উচিত ছিল।
হোসেন ভাই জানেন?
একথা তাকেই জিজ্ঞেস করবেন।
এমন সময় হোসেন এসে আসমাকে বলল, এখনো তুমি ঘরে যাওনি? দাইহান ভাই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। যয়নাব খুব কাঁদছে।
আসমা বলল, মালেকা আপার সঙ্গে গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। এক্ষুনি যাচ্ছি। তারপর মালেকাকে বলল, ইনশাআল্লাহ কাল দেখা হবে। কথা শেষ করে বাইরে এসে স্বামীকে বলল, চল।
পরের দিন আসমা স্বামীকে নিয়ে রুকসানাকে দেখতে বাহিরবাগ গেল। স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসিয়ে আসমা উপরে গেল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় বারান্দায় উঠে সুরাইয়া ভাবিকে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, সই কেমন আছে?
সূরাইয়া বলল, ভালো নয়। তারপর জিজ্ঞেস করল, দাইহান ভাইয়ের সঙ্গে এসেছেন নিশ্চয়?
হ্যাঁ, উনি নিচে বসে আছেন। আমি সই-এর রুমে যাই।
বড় আপা নেই। গতকাল তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এমন সময় করিমনকে আসতে দেখে সুরাইয়া তাকে বলল, নিচে মেহমান আছে, চা-নাস্তা দিয়ে এসে আমার ঘরেও আসমা আপার জন্য নিয়ে আসবে। তারপর আসমাকে বলল, আপনি আমার ঘরে চলুন, কথা আছে।
ঘরে এসে আসমাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, বড় আপার শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছিল দেখে আমি আপনার ভাইদেরকে একদিন বড় আপার বিয়ে না করার কারণ ও হোসেন স্যারের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় পরামর্শ করলাম। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব বলে বলল, আমার দৃঢ় ধারণা, বড় আপা আমার ও আব্বার সব কথা-বার্তা শুনেছে। কারণ সেই রাতেই বড় আপা ঘরের মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে বড় আপার অবস্থা এমন হল যে, কয়েকদিনের মধ্যে বিছানায় পড়ে গেল। গোপালগঞ্জ থেকে বড় ডাক্তার আনিয়ে চিকিৎসা করিয়েও কোনো কাজ হয়নি। শেষে সেই ডাক্তারের কথামতো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আমার কেবলই মনে হয়, বড় আপার এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। আমি যদি সেদিন আব্বাকে ওদের সম্পর্কের কথা না বলতাম, তাহলে বড় আপার অবস্থা এরকম হত না।