রুকসানা বলতে শুরু করল।
আমাদের বাগানের এখন যে দারোয়ান আছে, তার আগে ছিল কাজেম সেখ। দাদির মুখে শুনেছি কাজেম সেখের বাবার নাম সাজ্জাদ সেখ। সেও আমাদের দারোয়ান ছিল। সাজ্জাদ সেখের বাড়ি ছিল দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে। সে দরিদ্র কৃষক হলেও সংসারে অভাব ছিল না। লম্বা চওড়া, শক্ত সমর্থ সুপুরুষ ছিল। একা তিন চারজন কামলার সমান কাজ করত। তাই তার কাজের অভাব হত না। কাজেমের বয়স যখন চার বছর তখন তার মা মারা যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সাজ্জাদ ছেলেকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে। তাকে কার কাছে রেখে কাজে যাবে? মাঝে মাঝে পাড়া-পড়শীর কাছে রেখে কাজ করতে গেলে কাজেম সারাদিন মায়ের জন্য কান্না কাটি করত। অনেকে তাকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। সাজ্জাদ স্ত্রীকে খুব ভালবাসত। তা ছাড়া স্ত্রী মৃত্যু শয্যায় তাকে বলেছিল, আমি মরে গেলে তুমি আবার বিয়ে করলেও কাজেমের দিকে লক্ষ্য রেখ। তাকে সত্য যেন কষ্ট না দেয়। সাজ্জাদ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেছিল, আবার বিয়ে করব কিনা জানি না। তবে আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন ওর এতটুকু কষ্ট হতে দেব না। তাই পাড়া পড়শি যখন তাকে আবার বিয়ের কথা বলে তখন স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। পরে যাকে বিয়ে করব, সে যদি কাজেমকে দেখতে না পারে? আমি কাজ করতে চলে যাওয়ার পর যদি তাকে কষ্ট দেয়? এইসব চিন্তা করে আর বিয়ে করেনি। পরের বছর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাজ্জাদ কাজ পায় না। ঘরে যা কিছু ছিল বেঁচে কিনে খেয়ে শেষ করে ফেলে। তারপর একদিন কাজের চেষ্টায় কাজেমকে নিয়ে দাদাজীর কাছে এসে বলল, হুজুর, এই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে কাজ দেন। আজ দু’দিন পানি ছাড়া কিছু খেতে দিতে পারিনি।
কাজেমের মুখের দিকে তাকিয়ে দাদাজীর দয়া হল। একজন চাকরকে ডেকে কিছু খাবার এনে বাপ বেটাকে দিতে বললেন। তারপর নাম ধাম জেনে ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, এই লোকটার থাকার ও কাজের ব্যবস্থা করে দেন। সবকিছু দেখা শোনা করার জন্য দাদাজী একজন ম্যানেজার রেখেছিলেন।
ম্যানেজার তাকে বাগানের দারোয়ানের কাজে লাগিয়ে দিলেন। আর থাকার জন্য বাগানের পাশে একটা ঘর করে দিলেন।
সাজ্জাদ খুব পরিশ্রমী। তার কাজ কাম দেখে দাদাজী খুব খুশী হলেন। বছর খানেক পর একদিন দাদাজী তাকে বললেন, কাজেমকে স্কুলে ভর্তি করে দাও। খরচ যা লাগে আমি দেব। প্রত্যেক মানুষের অল্প কিছু হলেও লেখাপড়া করা উচিত।
দাদাজীর কথা মতো সাজ্জাদ কাজেমকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। একবার সাজ্জাদের কঠিন অসুখ হয়। দাদাজী চিকিৎসা করালেন। সুস্থ হওয়ার পর বললেন, তোমার বিয়ে করা উচিত। এই যে অসুখে এতদিন কষ্ট পেলে, বৌ থাকলে সেবা যত্ন করত, ছেলেটাকেও মানুষ করত। তা ছাড়া বৌ না থাকলে পুরুষদের অনেক রকম অসুবিধা হয়। তুমি রাজি থাকলে আমি ব্যবস্থা করব।
সাজ্জাদ বলল, হুজুর, আপনি আমার ভালোর জন্য বলছেন; কিন্তু কাজেমের ভালো মন্দ চিন্তা করে আমি আর বিয়ে করব না বলে ঠিক করেছি। মাফ করবেন। হুজুর, এ ব্যাপারে আর কিছু বলবেন না। এরপর দাদাজী তাকে আর বিয়ে করার কথা বলেন নি।
কাজেম যখন এইটে পড়ে তখন সাজ্জাদ মারা যায়। সাজ্জাদ মারা যাওয়ার পর কাজেম আর লেখাপড়া করল না। দাদাজী তাকে তার বাবার কাজে নিয়োগ করেন।
কাজেমও বাপের মতো সুন্দর ও স্বাস্থবান ছিল। তখন তার বয়স চৌদ্দ পনের বছর হলেও লম্বা চওড়া হওয়ার কারণে তাকে পূর্ণ যুবকের মতো দেখাত। সেও বাপের মতো পরিশ্রমী ছিল। তার কাজকর্মেও দাদাজী খুশী হলেন। আট দশ বছর পর তার বিয়ে দেন। বিয়ের প্রায় ছয় সাত বছর পর কাজেমের স্ত্রী এক পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। দাদাজী তার নাম রাখলেন ইকবাল হোসেন।
ইকবাল দেখতে শুনতে তার বাবার চেয়ে সুন্দর। পাঁচ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত সে একা একা বাগানে খেলা করত।
ছোটবেলায় আম্মা আমাকে বাইরে বেরোতে দিত না। বাইরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করার জন্য আমার মন খুব ছটফট করত। আমাদের বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে বাগানে যাওয়ার পথ খুব কাছে। তাই মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঐ পথে বাগানে গিয়ে ইকবালের সঙ্গে খেলা করতাম। ইকবালের বাবাকে আমি কাজেম চাচা বলে ডাকতাম। তার মাকেও চাচি বলে ডাকতাম। ইকবালের মা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। আমাকে খুব স্নেহ করত। চাচা যখন বাগানের গাছে পানি দিত, নতুন গাছ লাগাত অথবা বাগান পরিষ্কার করত তখন আমরা তার কাজে দুষ্টমী করে বাধা দিতাম। কাজেম চাচা একটুও রাগ করত না। আমাদের মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে অন্য জায়গায় খেলতে বলত।
ইকবাল আমার চেয়ে হয়তো দু’বছরের বড়। কাজেম চাচা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সে যে বছর টুয়ে উঠল, সে বছর আমি স্কুলে ভর্তি হই। ছোটবেলা থেকে বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় আম্মা আমাকে কালো চশমা পরিয়ে রাখত। চশমার কাঁচ কালো হলেও দিনে অথবা রাতে সমান দেখতে পেতাম। সে সময় আম্মা আমাকে বলে দিয়েছিল কেউ যদি চশমা খোলার কথা বলে, তা হলে বলবি, চোখের অসুখ, ডাক্তার খুলতে নিষেধ করেছে। বাগানে ইকবালের সঙ্গে খেলতে ও স্কুলে যাওয়ার সময় চশমা পরতাম। স্কুলে ইকবাল ছাড়া ক্লাসের কোনো ছেলে মেয়ের সঙ্গে খেলতাম না। কারো সঙ্গে মেলামেশাও করতাম না। ইকবাল সব সময় আমাকে কালো চশমা পরতে দেখলেও ছেলে মানুষ বলে হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার মাস ছয়েক পর একদিন বাগানে খেলা করার সময় বলল, তুমি সব সময় কালো চশমা পর কেন? আমি তখন মায়ের শেখানো কথা বললাম। ইকবাল সরল মনে তাই বিশ্বাস করল। দীর্ঘ চার বছর এক সঙ্গে খেলাধুলা ও স্কুলে যাতায়াতের ফলে আমাদের মধ্যে শিশুসুলভ ভালবাসার জন্ম হয়। ইকবাল ফাঁইভে টেলেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হল। পরের বছর আমিও টেলেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে সিক্সে ভর্তি হলাম। ইকবালের তখন ক্লাস সেভেন। সেই বছর আশ্বিন মাসের আজকের তারিখে ঠিক এই রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছিল। সেদিন স্কুল থেকে। ফিরে নাস্তা খেয়ে বাগানে খেলতে গেলাম। ইকবাল তখনও আসেনি। আমি একটা পেয়ারা গাছে উঠে ঝসাল দেখে বড় বড় দুটো পেয়ারা পাড়লাম। তারপর গাছের গোড়ায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।