মালেকা বোরখা খুলতে খুলতে বলল, আপনারা কোথাও যাচ্ছিলেন মনে হয়।
আসমা বলল, হ্যাঁ, এক আত্মীয়ের বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছিলাম। আপনাদেরকে ফেলে তো আর যেতে পারি না, অন্য দিন যাব। আপনারা যে আসবেন, হোসেন ভাই আমাদের বলেছে।
মালেকা বলল, স্যার আমাদের আসার কথা বললেও পরিচয় তো জানেন না। বলছি শুনুন, আমি মালেকা। ফরিদপুর মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করি। আর ওঁরা হলেন আমার আব্বা আম্মা। আমাদের বাড়িতে থেকে স্যার লেখাপড়া করেছেন।
ততক্ষণে রশিচাচি এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখিয়ে আসমা বলল, ইনি হোসেন ভাইয়ের সংসারের সব কাজ করে। তারপর রশিচাচিকে বলল, মেহমানদের অজুর পানি দিয়ে রান্নাঘরে এস, রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে। কথা শেষ করে চলে গেল।
আসমা তাড়াতাড়ি করে আলুভাতে ডাল রান্না করল। তারপর ডিম ভাজি করে মেহমানদের খেতে দিয়ে বলল, এত অল্প সময়ে বেশি কিছু করতে পারিনি। এই দিয়েই একমুঠো খান।
খাওয়া শেষ করে মেহমানরা উঠে বসেছে। এমন সময় রহিমন এসে আসমাকে বলল, যয়নাব খুব কাঁদছে। তাকে দুধ খাইয়ে এস। আমি ততক্ষণ এখানে আছি।
আসমা রশিচাচিকে থালা-বাসন ধুতে বলে ঘরে চলে গেল।
রহিমন আলাপ পরিচয় করে বলল, হোসেনের মুখে আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। তাই দেখতে এলাম। আপনারা ইকবালকে মানুষ না করলে আজ এতবড় হতে পারত না। এর বদলা আল্লাহ আপনাদেরকে দেবে। আজ যদি ওর মা-বাপ বেঁচে থাকত, তাহলে কতই না খুশী হত। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসীব করুক।
ফরিদা জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন।
রহিমন বলল, এক ছেলে তিন মেয়ে। ছেলের প্রথম স্ত্রীর একটা ছেলে রেখে মারা গেছে। সেই নাতিকে আমি মানুষ করি। এখন তার কাছেই আছি। আমার ছেলে আবার বিয়ে করেছে। তার ঘরে চার পাঁচটা ছেলে মেয়ে হয়েছে।
মালেকা বলল, আসমা আপা তা হলে আপনার নাত বৌ?
রহিমন বলল, হ্যাঁ। আসমার মতো নাতবৌ পেয়ে আল্লাহ আমাকে খুব সুখে রেখেছে।
এমন সময় আসমা ফিরে এসে বলল, দাদি আপনি এবার যান। যয়নাবকে ওর বাপের কাছে দিয়ে এসেছি। সে যেন কোথায় যাবে।
রহিমন মেহমানদের উদ্দেশ্যে বলল, এখন যাই। পরে আবার আসব।
রহিমন চলে যাওয়ার পর হোসেন স্কুল থেকে ফিরে মেহমানদের দেখে খুশী হল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কখন এলেন? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
খালেক বলল, তিনটের দিকে এসেছি। তারপর বলল, মালেকা সঙ্গে না থাকলে অসুবিধা একটু হত। আমরা পরশু মালেকার কাছে এসে ছিলাম।
স্যারকে দেখে মালেকা ওড়নাটা নাকের উপর দিয়ে মুখ ঢেকে দিল।
হোসেন আসমাকে বলল, মেহমানদের খাওয়া-দাওয়া করিয়েছ?
হ্যাঁ, ঘরে যা ছিল তাই রান্না করে খাইয়েছি। তুমি খাবে চল।
আমি এমন সময় কিছু খাই না। তোমাদের আজ বাহিরবাগ যাওয়ার কথা ছিল না?
আমরা যাওয়ার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় এসে ওঁদের সঙ্গে দেখা। তাই আর যাওয়া হল না। ইনশাআল্লাহ কাল যাব।
দাইহান ভাই কোথায়?
মেহমানদের সঙ্গে এসেছিল। এখন ঘরে আছে। কোথায় যেন যাবে বলছিল।
তুমি গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এস বাজারে যাব।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর হোসেন আসমাকে বলল, মেহমানদের ঘুমাবার ব্যবস্থা করে তারপর যেও। আমি দাইহানকে নিয়ে তোমার আব্বার ওখানে যাচ্ছি। সেখানে কমিটির মেম্বাররা আসবেন। তাদেরকে নিয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করব। কথা শেষ করে দাইহানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
হোসেনের ঘরেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আসমা মেহমানদেরকে বলল, আপনারা এখানেই বসুন, আমি বিছানা করে দিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, এবার আপনারা ওঘরে যান।
মালেকা আব্বা-আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা যাও, আমি আসছি। তারা যাওয়ার পর আসমাকে বলল, আপনি বসুন, কিছুক্ষণ গল্প করি।
আসমা বসে বলল, আমি গ্রামের মেয়ে কি আর গল্প করব, তার চেয়ে আপনি শহরের গল্প করুন।
গল্প করতে করতে একসময় কথা প্রসঙ্গে মালেকা বলল, স্যার আপনাকে বাহিরবাগ যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে ওঁর কেউ আছেন নাকি?
আসমা উত্তরটা একটু পাশ কেটে বলল, বাহিরবাগের চৌধুরীদের মেয়ে রুকসানা আমার সই। তার অসুখ। তাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মাইণ্ড করবেন না তো?
মালেকা প্রথম থেকে আসমার কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে বুঝতে পেরেছে সে শিক্ষিত। বলল, মাইণ্ড করার কি আছে? আপনি বলুন।
ছাত্র জীবনে না হয় হোসেন ভাইকে স্যার বলতেন, এখনও বলেন কেন?
দুঃখিত বলতে পারব না। তবে আমার মতে ছাত্র-ছাত্রীর বয়স যতই হোক না কেন, শিক্ষককে স্যার বলাই উচিত। আচ্ছা, স্যারের বয়স তো অনেক হয়েছে, বিয়ে করেন না কেন?
আসমা বুঝতে পারল, হোসেন ভাই ও রুকসানার সম্পর্কের কথা এরা জানে না। বলল, হোসেন ভাই ছোটবেলা থেকে আপনাদের কাছে অনেক বছর ছিল, আপনাদেরই তো জানার কথা।
তা অবশ্য ঠিক, স্যার আমেরিকা যাওয়ার আগে আম্মা-আব্বা বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। স্যার তখন রাজি হননি। আমেরিকা থেকে ফেরার পরও তারা বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন। স্যার বললেন, গ্রামে থাকবেন এবং গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবেন। প্রায় এক বছর হতে চলল গ্রামে এসেছেন। এখনও করেনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আর একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে, স্যারের নাম তো ইকবাল, আপনারা হোসেন বলছেন কেন?