সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব, যদি অনুমতি দেন।
বল, কি জানতে চাও।
কে সেই ভাগ্যবতী? যার প্রতীক্ষায় এত বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন?
তার কথা বলতে পারব না। তাকে সারা জীবনে পাব কিনা তাও জানি না। এ পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই। মা-বাবাকে হারাব বলে হয়তো আল্লাহ আমাকে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তোমাদেরকেই আপন বলে জানি। তাই তোমাদের কারো দুঃখ দেখলে আমিও দুঃখ পাই। তুমি বিয়ে করে সংসার করছ শুনলে, চাচা-চাচির চেয়ে আমিও কম শান্তি পাব না।
স্বার্থপরের মতো আপনি শুধু নিজের শান্তির কথা বলছেন, কিন্তু কখনও কী ভেবেছেন, যার জন্য আপনি দুঃখ পাচ্ছেন সেও আপনার জন্য দুঃখ পাচ্ছে? তারপর কান্না সামলাতে না পেরে মালেকা সেখান থেকে চলে গেল। হোসেন চিন্তা করল জেনেশুনে প্রসঙ্গটা তোলা খুব ভুল হয়েছে।
ঢাকায় দু’তিন দিন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী নির্দিষ্ট দিনে আসবেন সিওর হয়ে আজ দশ দিন হল হোসেন ফিরে এসেছে। আসার সময় চাচা-চাচিকে সে কথা জানিয়ে উদ্বোধনের চার পাঁচ দিন আগে সবাইকে নিয়ে আসতে বলে এসেছে। এক ফাঁকে মালেকাকেও বলেছে, তুমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসবে। মালেকা হা-না কিছু না বলে তার কাছে থেকে চলে গেছে।
গ্রামে ফিরে হোসেন তাদের আসার কথা বলে দাইহানকে একটা ঘর বানাবার দায়িত্ব দিয়েছিল। দাইহান এক সপ্তাহের মধ্যে ঘরটা কমপ্লিট করে বলল, এবার তো ঘরের আসবাবপত্র লাগবে। হোসেন তাকে কিছু টাকা দিয়ে বুলল, যা কিছু দরকার তুমিই ব্যবস্থা কর।
এর মধ্যে একদিন আসমা হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, রুকসানার খোঁজ খবর রাখ?
হোসেন বলল, কয়েকদিন আগে স্কুলে মনিরার কাছে শুনেছি, বেশ কিছুদিন থেকে রুকসানা অসুস্থ। শোনার পর দেখতে যাব মনে করেছিলাম, চৌধুরী সাহেবের কথা। চিন্তা করে যাইনি। মনিরাও এই কয়েকদিন স্কুলে আসছে না। তাই কিছু বলতে পারছি না।
আসমা বলল, আমি তোমার ভাইকে নিয়ে কাল একবার যাব ভাবছি।
তাই যাও। দেখে এসে জানাবে কেমন আছে। এদিকে হাসপাতাল উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। খুব ব্যস্ত রয়েছি।
ঢাকা থেকে কারা যেন আসবেন বলেছিলে, কই তারা তো এলেন না?
দু’এক দিনের মধ্যে আসতে পারে।
আসমা রাত্রে স্বামীকে রুকসানার অসুখের কথা জানিয়ে বলল, কাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে দেখতে যাব। তুমি মাঠ থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে।
পরের দিন হোসেন স্কুলে যাওয়ার সময় ভাবল, আজ যদি মনিরা আসে, রুকসানার খবর জানা যাবে। স্কুলে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সে আসেনি। মনিরা না আসার কারণ ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, রুকসনার অসুখ বাড়বাড়ি হয়নি তো? তারপর আজ আসমার যাওয়ার কথা মনে পড়তে ভাবল, সে ফিরে এলে জানা যাবে।
বেলা তিনটের দিকে আসমা ও দাইহান যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে এমন সময় লম্বা কোর্তাপরা একজন টুপি দাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে দু’জন বোরখাপরা মেয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দাইহান বলল, লোকটাকে অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, ঢাকা থেকে যাদের আসার কথা হোসেন বলেছিল, এরা তারাই।
আসমা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক।
খালেক স্ত্রীকে নিয়ে পরশু ফরিদপুরে এসে মেয়ের কাছে ছিল। মালেকা কাল কলেজে গিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আজ সকালে মা বাবাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। বাস থেকে নেমে রিকশা নিয়ে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে এসে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে হেঁটে আসছিল। আসমা ও দাইহানকে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে খালেক সালাম দিল।
দাইহান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনারা কোথায় যাবেন?
খালেক বলল, আমরা ঢাকা থেকে আসছি। মরহুম কাজেম সেখের ছেলে ইকবালের বাড়িতে যাব।
আসমা স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আজ আর যাওয়া হবে না, কাল যাব। ইনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
দাইহান খালেকের দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন আমাদের সঙ্গে। তারপর যেতে যেতে বলল, ইকবাল আমার চাচাতো ভাই। তার বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি। সে এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি।
বাড়ি করে ডাক্তারী শুরু করার পর হোসেন রশিদা নামে একজন বয়স্কা বিধবা গরিব মেয়েকে ঘরের সব কাম-কাজ করার জন্যে রেখেছে। তাকে সবাই রশিচাচি বলে ডাকে। সে সারাদিন থাকে। এশার নামাযের পর হোসেনকে খাইয়ে নিজে খায়। তারপর ঘরে চলে যায়। আগে সে ভিক্ষা করে দিন গুজরান করত। আর রাজ্জাক, নামে একজন লোককে কম্পাউন্ডার রেখেছে। সে আগে হোমিও বই দেখে দেখে ডাক্তারী করত। ইকবাল তাকে বেতন দিয়ে রেখেছে।
হোসেন যে নতুন ঘর বানিয়েছে, মেহমানদেরকে সেই ঘরে নিয়ে এসে বসতে বলল। তারপর আসমা স্বামীকে বলল, রশিচাচি বোধ হয় হোসেন ভাইয়ের ঘরের মেঝেয় পাটি মেলে ঘুমাচ্ছে, তাকে ডেকে নিয়ে এস। মেহমানদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে।
দাইহান বলল, আমি রশিচাচিকে ডেকে দিয়ে ঘর থেকে একটু ঘুরে আসি।
আসমা বলল, তাই এস। তারপর মেহমানদেরকে বলল, উনি আমার স্বামী। হোসেন ভাইয়ের আব্বা আর আমার শ্বশুর চাচাতো ভাই। এই ভিটের উত্তর পাশে আমাদের বাড়ি। আপনাদের বোধহয় জোহরের নামায পড়া হয়নি। কাপড় পাল্টে নামায পড়ে নিন। অজুর ব্যবস্থা করছি।