কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান হচ্ছে শুনে উঠে কাপড় পাল্টে বাথরুম থেকে অযু করে এল। তারপর নামায ও অজিফা পড়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মোনাজাতের সময় আল্লাহর কাছে জানাল, “হে মহান প্রভু আল্লাহ, তুমি সর্বজ্ঞ। সারা সৃষ্টি জগৎ তোমার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে। তুমি সমস্ত সৃষ্টি জীবের মনের খবর জান। আমি তোমার একজন নাদান বান্দী। আমার মনের নেক বাসনাগুলো তুমি পূরণ করো। তুমি তো জান, আমি ইকবালের জন্য কত বছর ধৈর্য ধরে রয়েছি। ইকবালও আমার জন্য এতবছর ধৈর্য ধরে আমার উপযুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে। আমাদেরকে জোড়া হিসাবে কবুল কর। আমাদের মিলনের পথে যে বাধা, তা দূর করে দাও। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। তোমার রহমতে ও তোমার পেয়ারা হাবিবের অসিলায় আমার গোনাহ খাতা মাফ করে দিয়ে আমার স্বপ্ন সফল করে দাও, আমিন।” তারপর বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে গেল।
নাস্তা খেয়ে ফিরে আসার সময় রুকসানা মনিরাকে বলল, আমার রুমে আয়।
মনিরা তখন চা খাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে কাপটা নামিয়ে রেখে বড় আপার রুমে এসে বলল, কেন ডেকেছ বল।
আব্বা তোকে হোসেন স্যারের কাছে পড়তে নিষেধ করা সত্ত্বেও তুই নাকি বলেছিস, তার কাছে পড়বি?
হ্যাঁ বলেছি। আচ্ছা বড় আপা, তুমিই বল তো, স্যারের বাবা আমাদের দারোয়ান ছিল, তাতে স্যারের কাছে পড়তে দোষ কোথায়? বড় বড় মনিষীদের বাবারাও অনেকে গরিব ছিলেন, অনেকে চাষী ছিলেন। আবার অনেকে ছোটখাট চাকরিও করতেন।
তোর কথা ঠিক, তবে আব্বা যখন নিষেধ করেছে তখন না পড়াই ভালো।
বড় আপা, তুমিও নিষেধ করবে ভাবতে পারিনি। স্যার দারোয়ানের ছেলে বলে যদি তুমিও নিষেধ কর, তোমার নিষেধও শুনব না বলে মনিরা হনহন করে চলে গেল।
তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুকসানার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
এরপর থেকে রুকসানা দিনের পর দিন মুষড়ে পড়তে লাগল।
৮. হোসেন স্যারের আসল পরিচয়
হোসেন স্যারের আসল পরিচয় চৌধুরী বাড়ির সবাই জেনে অবাক হলেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না। কিন্তু বড় বৌ সুরাইয়া মাথা না ঘামিয়ে পারল না। এক ছুটির দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রুকসানার রুমে গেল।
রুকসানা শুয়ে শুয়ে ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিল। তাকে দেখে উঠে বসে বলল, কি ব্যাপার? এমন সময় তো তুমি আমার রুমে কখনো আসনি? কিছু দরকার থাকলে বলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়।
সুরাইয়া তার পাশে বসে বলল, বড় আপা, তুমি কাকে সব থেকে বেশি ভালবাস বলবে?
রুকসানা বলল, তাহলে কোনো দরকারে আসনি? করিম বুঝি ঘরে নেই? তাই ফাজলামী করতে এসেছ? যাও ভাগো। আমার শরীর ভালো না, একটু ঘুমাব।
আমার কথার জওয়াব না দিলে যাব না।
তুমি একটা আস্ত পাগল, তাই পাগলের মতো কথা বলছ। তোমাকে সবার। থেকে বেশি ভালবাসি বললে মনিরা মমতাজ ও আরেফা কি মনে করবে ভেবে দেখেছ?
আমি কিন্তু তা জানতে চাইনি। শোন বড় আপা, তোমার ভাইয়ের কাছে ইকবাল হোসেন স্যারের সব কথা শুনেছি। তোমার কাছে ওয়াদা করেছিলাম বলে আজও কাউকে বলিনি। কিন্তু এখন আর সেই ওয়াদা রাখতে পারব না। তাই অনুমতি নিতে এসেছি, তুমি যে ইকবাল হোসেন স্যারের জন্য আজও অপেক্ষা করে আছ, সে কথা তোমার ভাইকে জানিয়ে বিহিত করার জন্য।
এমন সময় করিমন বুয়া এসে রুকসানকে বলল, আপনার সই এসেছেন। তিনি চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে কথা বলছেন। আম্মা আপনাকে খবরটা দিতে বললেন।
রুকসানা তাকে বলল, তুমি যাও, আমি আসছি। করিমন চলে যাওয়ার পর সুরাইয়াকে বলল, এখন যাও। তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব। তারপর দুজনে একসঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে এসে রুকসানা আব্বার রুমে গেল।
আসমা স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসিয়ে উপরে উঠে আজিজা বেগমকে দেখে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল। তারপর বলল, চাচি আম্মা আপনারা কেমন আছেন?
আজিজা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, বেঁচে থাক মা, আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। তারপর বললেন, আল্লাহর রহমতে আমি এক রকম আছি মা; কিন্তু তোমার চাচার সেই একই অবস্থা। এতবছর চিকিৎসা চলছে কোনো উন্নতিই নেই।
আসমা বলল, চলুন চাচার কাছে যাব।
আজিজা বেগম করিমনকে ডেকে বললেন, রুকসানাকে বল, তার সই এসেছে। তারপর আমাকে বললেন এস মা। রুমে ঢুকে আজিজা বেগম স্বামীকে বললেন, দক্ষিণ ফুকরা থেকে রুকসানার সই তোমাকে দেখতে এসেছে।
আসমা সালাম দিয়ে কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে চুমো খেয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, আমার আর থাকা না থাকা মা। তোমার আব্বা ভালো আছেন?
জ্বি, ভালো আছেন।
এমন সময় আব্দুল মতিন বড় মেয়েকে আসতে দেখে বললেন, রুকসানা আসছে। যাও মা তার ঘরে গিয়ে গল্প কর।
দরজার দিকে আসমার পিঠ ছিল, তাই রুকসানাকে আসতে দেখেনি। চাচার কথা শুনে ঘুরে তাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, সই, কেমন আছিস?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তারপর একটা হাত ধরে বলল, আমার রুমে চল। যেতে যেতে বলল, এবারে প্রায় দেড় বছর পর এলি। সয়াকে বলে এক সপ্তাহ রেখে দেব।
বিয়ের পর আসমা প্রতি বছর এসে দু’তিন দিন বেড়িয়ে যায়। চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে চিনে। বাচ্চা হওয়ায় ও ইকবাল আসার ফলে দেড় বছর আসতে পারেনি। রুকসানার কথা শুনে বলল, পাগলামী করবি না। এবারে একদিনও থাকতে পারব না। কোলের বাচ্চাকে রেখে এসেছি এক্ষুনি চলে যাব। তাই তোর সয়াকে নিচে বসিয়ে রেখেছি।