রাবেয়া অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, আমি বুঝি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার পরিচয় বলে বেড়াতাম?
তা হয়তো করতে না, তবে মেয়েদের পেটে কোনো কথা হজম হয় না। এক কান দু’কান করে একদিন প্রচার হয়ে যেতই।
থাক, কথাটা জিজ্ঞেস করাই আমার অন্যায় হয়েছে।
আহ, রাগ করছ কেন? ঠিক আছে, তোমাকে না জানিয়ে আমিই অন্যায় করেছি। মাফ করে দাও।
রাবেয়া স্বামীর পিঠে একটা আদরের কিল দিয়ে বলল, এই মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করছ কেন? রাগ দেখিয়ে আমিও অন্যায় করেছি। আমারই মাফ চাওয়া উচিত। বল মাফ করে দিয়েছ?
কায়সার মৃদু হেসে বলল, মেয়েদের মন বোঝা মুশকিল। এই রাগ, এই পানি। তারপর বলল, অন্যায় কেউ-ই করেনি। অতএব এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা না। বলাই ভালো।
.
আব্দুর রসিদ ঘরে ফিরে আব্বাকে বলল, জান আব্বা, হোসেন স্যার দক্ষিণ ফুকরার কাজেম সেখের ছেলে। তারপর চেয়ারম্যান হোসেন স্যারের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন বলল।
আব্দুল মতিন খুব অবাক হয়ে চমকে উঠে বললেন, কী বলছ তুমি? এটাও কি সম্ভব? তখন তার বিশ-একুশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ল, “এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে রুকসানার বুকে হাত দিয়েছিল বলে তার বাপকে দিয়ে শংকর মাছের চাবুক মেরে শাস্তি দিয়েছিলেন।”
আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে আব্দুর রসিদ বলল, আমি এখন যাই আব্বা?
আব্দুল মতিন বললেন, হ্যাঁ যাও।
আজিজা বেগম সেখানে ছিলেন। কথাটা শুনে তিনিও খুব অবাক হয়েছেন। বড় ছেলে চলে যাওয়ার পর বললেন, আল্লাহ কখন কাকে কি করেন, তা তিনিই জানেন। হোসেন স্যার কাজেম সেখের ছেলে, ভাবতেই পারছি না।
আব্দুল মতিন বললেন, আমারও খুব অবাক লাগছে। যাকগে, মনিরাকে একটু ডাকতো?
আজিজা বেগম বাইরে এসে ছোট বৌ মমতাজকে দেখতে পেয়ে বললেন, মনিরাকে ডেকে দাও।
আব্দুর রশিদ আব্বার কাছ থেকে এসে স্ত্রীকে হোসেন স্যারের আসল পরিচয় বলছিল। মনিরাও সেখানে ছিল। ছোট ভাবির ডাক শুনে তার কাছে এসে বলল, কেন ডাকলে?
মমতাজ বলল, আম্মা ডাকছেন।
মনিরা রুমে ঢুকে বলল, আম্মা ডেকেছ?
আজিজা বেগম বলার আগে, আব্দুল মতিন বললেন, হোসেন স্যারের আসল পরিচয় শুনেছিস?
আগে জানতাম না, এখন বড় ভাইয়ার কাছে শুনলাম।
আব্দুল মতিন গম্ভীর স্বরে বললেন, ছুটির পর তার কাছে আর পড়বি না।
মনিরা খুব স্পষ্টভাষিনী। তাই আব্বাকে ভয় করলেও বলল, কেন?
আব্দুল মতিন রাগের সঙ্গে বললেন, কেন আবার। নিষেধ করলাম পড়বি না। কাজেম সেখ ও তার বাবা আমাদের বাগানের দারোয়ান ছিল। জেনে শুনে দারোয়ানের ছেলের কাছে তোকে পড়তে দিতে পারি না। শোন, আমাদের বংশের মান সম্মান আছে। লোকে শুনলে কী বলবে?”
মনিরা বলল, আব্বা তোমার কথা মানতে পারব না। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। হোসেন স্যারের বাপ-দাদারা হয়তো গরিব ছিল, তাই তারা তোমাদের কাছে দারোয়ানীর চাকরি করেছে। তাই বলে তাদের ছেলেকে ঘৃণা করা কি ঠিক হচ্ছে? তা ছাড়া হোসেন স্যার আমার শিক্ষক। বড় আপার কাছে শুনেছি, হাদিসে আছে, “আল্লাহ ও তার রাসূলের পরে মা-বাবার স্থান, তার পরেই শিক্ষকের স্থান। উনি আমার শিক্ষক, আমি তার কাছে পড়বই। কথা শেষ করে হনহন করে চলে গেল।
আব্দুল মতিন ছোট মেয়ের স্বভাব জানেন, তবু বললেন, আব্দুল করিম ঠিকই বলে, মনিরা সত্যিই দিন দিন, বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। তারপর চোখ বন্ধ করে ইকবালের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
রুকসানা ঘরে ফিরে ওষুধ খাওয়ার জন্য আব্বার রুমে এল। তাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে আব্বা বলে ডাকল।
আব্দুল মতিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আয় বস।
রুকসানা বলল, আগে ওষুধ খেয়ে নাও, তারপর বসছি। তারপর ওষুধ খাইয়ে আব্বার পাশে বসে বলল, কিছু বলবে আব্বা?
তুই কী দক্ষিণ ফুকরায় মিটিংএ গিয়েছিলি?
হ্যাঁ, আমাদের অফিসের রাবেয়া ও কায়সারের সঙ্গে গিয়েছিলাম।
আব্দুল করিম একটু আগে এসে যখন বলল, হোসেন স্যার কাজেমের ছেলে তখন বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপর চেয়ারম্যান সাহেবের কথা বলতে বিশ্বাস হল। এখন বুঝতে পারছি, সেদিন তাকে বসতে বলার পরও কেন বসল না। চাকরের ছেলে হয়ে কি মনিবের সামনে সোফায় বসতে পারে? আগে যদি জানতাম হোসেন স্যার আমাদের দারোয়ানের ছেলে, তা হলে তোকে নিয়ে আসতে বলতাম না। আর মনিরাকেও তার কাছে পড়তে দিতাম না। শোন, একটু আগে মনিরাকে তার কাছে পড়তে নিষেধ করেছি; কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। তাকে তুই নিষেধ করে দিস। আমার বিশ্বাস, তোর কথা সে শুনবে।
তুমি তাকে পড়তে নিষেধ করলেন কেন আব্বা?
আব্দুল মতিন বিরক্ত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য? কারণট বোঝা তোর উচিত ছিল। ভুলে যাচ্ছিস কেন, কয়লা হাজারবার ধুলেও তার কালো র যায় না। একটা চরিত্রহীন লম্পটের কাছে মনিরার পড়া কি…..
রুকসানা আর সহ্য করতে না পেরে আব্বার কথা শেষ করার আগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই আব্বা, এখনও কাপড় পাল্টাইনি। কথা শেষ করে চলে গেল।
আব্দুল মতিন অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, মনিরাকে যা বলতে বললাম, বলে দিস।
আব্বার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার কথাগুলো রুকসানার মনে তীরের মতো বিধেছে। তার সামনে এতক্ষণ সহ্য করতে পারলেও নিজের রুমে এসে আর পারল না। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।