আসমা বলল, এটা তুমি ঠিক বললে না হোসেন ভাই। হাদিছে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে ইচ্ছা করে যে তাহার উপার্জন বৃদ্ধি হউক এবং তাহার মৃত্যু বিলম্বে হউক, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।” [বর্ণনায়- হযরত আনাস (রাঃ) বুখারী-মুসলীম]
হাদিছে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, সে বেহেশতে যাইবে না।” [বর্ণনায় হযরত জাবেরবীন মোতয়েম- বুখারী, মুসলীম]
তুমি নিশ্চয় এই হাদিসগুলো জান। তারপরও এই কথা বলতে পারলে?
হোসেন তওবা আস্তাগফির পড়ে বলল, আল্লাহ মাফ করুন। হাদিসগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে উপলক্ষ করে আল্লাহ আমাকে অনেক বড় গোনাহ থেকে রক্ষা করলেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে জানাই লাখোকোটি শুকরিয়া। তারপর বিদায় নিয়ে চলে এল।
.
কমিটির লোকজন মাইক দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মিটিং এর কথা প্রচার করিয়েছেন।
আজ মিটিং এর দিন। তিনটের সময় মিটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরের পর থেকে লোকজন আসতে শুরু করল। হাসপাতালের সামনে অনেক খানি মাঠ। সেখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা অতিথি হয়ে আসবেন তাদের জন্য ও বক্তাদের জন্য আলাদা কোনো স্টেজ করা হয়নি। হাসপাতালের বারান্দাতে চেয়ার টেবিল দেওয়া হয়েছে। তিনটের পর থেকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও তিনটে ওয়ার্ডের আটজন মেম্বার একে একে আসতে আরম্ভ করলেন। হোসেন নিজে গিয়ে আব্দুল মতিনকে গাড়ি করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তিনি অপারগতার কথা বলে বড় ছেলে আব্দুর রশিদকে পাঠাবার কথা বলেছিলেন। সেও এসেছে। সাড়ে তিনটের সময় চেয়ারম্যান আজিজুল হককে সভাপতি করে মিটিং এর কাজ শুরু হল। প্রথমে একটা চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে কুরআন তেলাওয়াত করল। তারপর অতিথি বৃন্দের অনেকে হোসেন স্যারের এই মহৎ কাজের প্রশংসা করে কিছু বক্তব্য রেখে সব রকমের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আব্দুল মতিনের বড় ছেলে আব্দুল রশিদ বক্তৃতা করার সময় আব্বার কথামত পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিল।
সব শেষে সভাপতি চেয়ারম্যান আজিজুল হক সমাপ্তির ভাষণে বললেন, যিনি একা নিজের চেষ্টায় এতবড় মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন এবং কাজও প্রায় শেষ করে এনেছেন। সেই মহান লোকটিকে আমরা একজন ভালো শিক্ষক, ভালো ডাক্তার ও একজন জনদরদী হিসাবে জানি। আমরা তার কাজ-কর্মে ও আচার ব্যবহারে এতই অভিভূত হয়েছি যে, তার পরিচয় জানতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। যেদিন উনি আমাকে এই মিটিং-এ আসার জন্য অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, সেদিন আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে যা বললেন, তা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে দোয়া করেছি। এখন তার পরিচয় বলছি শুনুন, তারপর হোসেনের আসল পরিচয় ও কিভাবে লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে গ্রামে ফিরে এল বলে বললেন, হোসেন স্যার আসল পরিচয় বলার পর আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, কথাটা গোপন রাখার জন্য। আমি রাজি না হয়ে বলেছিলাম, আপনি আমাদের দেশের কৃতী সন্তান। আপনার আসল পরিচয় সকলের জানা উচিত। তাই আপনাদেরকে জানালাম। ইনশাআল্লাহ আমিও যতটা সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করব। জনসাধারণের কাছে অনুরোধ করছি, আপনারাও এই মহৎ কাজে যে যা পারেন, তাই দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোক, এই দোয়া করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে মিটিং-এর সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আল্লাহ হাফেজ।
গ্রামের লোকজন হোসেন স্যার মরহুম কাজেম সেখের ছেলে জেনে যেমন অবাক হল তেমনি আনন্দিতও হল।
বাহিরবাগ গ্রাম থেকে অনেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে রুকসানা, রাবেয়া ও কায়সার ছিল। রুকসানা ভেবেছিল, মিটিং-এর পরে আসমার সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যাবে। সঙ্গে রাবেয়া ও কায়সার থাকায় সম্ভব হল না। তাছাড়া বেলাও বেশি ছিল না। তাই তাদের সঙ্গে ফিরে আসতে লাগল।
এক সময় রাবেয়া রুকসানাকে জিজ্ঞেস করল, তুই কাজেম সেখকে দেখেছিস?
রুকসানা বলল, হ্যাঁ দেখেছি। আমি যখন সিক্সে পড়তাম তখন ইকবাল পালিয়ে যায়। তার মাস ছয়েক পর কাজেম সেখ চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যায়।
তোর সঙ্গে তো হোসেন স্যারের দু’তিন বার আলাপ হয়েছে, চিনতে পারিস নি?
প্রায় বিশ একুশ বছর পর কাউকে দেখলে কি আর চেনা যায়? তবে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয়েছে।
কায়সার বলল, আমি কিন্তু ওঁর সম্পর্কে আগেই জেনেছি।
রুকসানা জিজ্ঞেস করল, কার কাছে জেনেছ? হোসেন স্যার বলেছেন?
কায়সার বলল, না, আমার মামাত ভাই আশরাফ ভাইয়ের কাছে। তিনি আর হোসেন স্যার ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়তেন। আশরাফ ভাই কিছুদিন আগে এসেছিলেন। আসার সময় পথে হোসেন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বাড়িতে এসে সেকথা আমাকে বললেন। তার কাছে আরো যা কিছু শুনেছিলাম চেয়ারম্যানের কথার নঙ্গে মিলে গেছে।
রুকসানা আর কিছু না বলে হাঁটতে লাগল।
গ্রামে ঢুকে কায়সার-রাবেয়ার ও রুকসানার পথ আলাদা। সেখানে পৌঁছে রুকসানা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর রাবেয়া স্বামীকে বলল, তুমি হোসেন স্যারের আসল পরিচয় জেনেও আমাকে এতদিন বলনি কেন?
কায়সার বলল, ভেবেছিলাম, হোসেন স্যার যখন আত্মগোপন করে আছেন তখন নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। তাই একজন জ্ঞানী-গুনী লোকের পরিচয় প্রকাশ করা উচিত হবে না ভেবে বলিনি।