ছোট ভাই আব্দুল করিম ও মনিরা কোলে পিঠে। তাই ছোটবেলা থেকে দু’জনের মধ্যে ঠকরা-মকরি লেগেই থাকে। মনিরাকে ঐ ভাবে চলে যেতে দেখে বলল, দেখলে বড় আপা, ও কতবড় বেয়াদব?
এতক্ষণ আজিজা বেগম ও আব্দুল মতিন কোনো কথা বলেন নি। আব্দুল করিমের কথা শেষ হতে আজিজা বেগম বললেন, রুকসানাই তো ওকে ঐ রকম করেছে। সবার ভুল ত্রুটি হলে রুকসানা রাগারাগি করে, আর মনিরা যত দোষই করুক না কেন তাকে একটুও কিছু বলে না।
আব্দুল মতিন এসব কথায় কান দিলেন না। রুকসানার দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা মাস্টার ঠিক করে দেনা মা, যদি সত্যি সত্যি এবছর ফেল করে?
রুকসানা তিন ভাইয়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তোমরা তো নিজেদের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাক। ওরই ফাঁকে একটা ভালো মাস্টার ঠিক করতে পার না?
বড় ভাই আব্দুর রশিদ বলল, এ বছর তিন চারজন মাস্টার ঠিক করলাম। তাদের কাছে চার পাঁচ দিন করে পড়ে বিদায় করে দিয়েছে। আমাদের দোষ কোথায়?
আজিজা বেগম রুকসানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মনিরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে, তুই ওকে একটু শাসন কর।
রুকসানা আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, মনিরার কত বয়স হল আব্বা?
আব্দুল মতিন বললেন, আমার কি আর অত মনে আছে। তুইই বল না। তোর তো সব কিছু নখদর্পণে।
রুকসানা বলল, মনিরার বয়স চৌদ্দ চলছে। এই বয়সে সব ছেলে মেয়েরাই একটু আধটু ওরকম হয়। ও একটু চঞ্চল। তাই ঐ রকম। দু’চার বছর পর ঠিক হয়ে যাবে।
সেজ ভাই আব্দুস সামাদ বলল, জান বড় আপা, কিছুদিন হল মনিরাদের স্কুলে ঢাকা থেকে একটা ভালো টিচার জয়েন করেছেন। এরই মধ্যে চারপাশের গ্রামে। সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। শুনেছি খুব কড়া টিচার। বেয়াদবি করলে বড় বড় ছাত্রীদেরকেও বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখেন।
বড় ভাই আব্দুর রশিদ বলল, এই রকম টিচারই মনিরার জন্য দরকার।
রুকসানা মৃদু হেসে আব্দুল করিমকে বলল, ওঁকে একদিন সঙ্গে করে নিয়ে আসিস, কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে এল। তখনও সমানে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। রুকসানা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চিন্তা করতে লাগল, এই দুর্যোগে কত গরিব লোকের ঘর বাড়ি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টিতে ছেলে মেয়ে নিয়ে লোকজন কষ্ট পাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হে গফুরুর রহিম, তোমার ভেদ তুমিই জান। তুমি সবাইকে হেফাজত কর।” আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে। এইরকম ঝড় তুফানের কথা মনে পড়তে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। এমন সময় বড় বৌ সুরাইয়াকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল। কাছে এলে বসতে বলে বলল, কিছু বলবে মনে হচ্ছে?
সুরাইয়া টেবিলের কাছ থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসে তার পাশে রেখে বসে বলল, মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যাই, যখন তুমি আমাদের মনের কথা টেনে বল। আমার মনে হয়, তুমি আল্লাহর খাস বান্দি। সে ছাড়া অন্য দু’জা রুকসানার সঙ্গে আপনি সম্বোধনে কথা বলে।
রুকসানা বলল, থাক অত আর ফোলাতে হবে না। যা বলতে এসেছ বল।
সুরাইয়া বলল, অনেক দিন থেকে একটা কথা বলতে চাই; কিন্তু সাহসে কুলায় না। তুমি যদি অভয় দাও, তা হলে বলতে পারি।
রুকসানা বলল, আচ্ছা তোমরা সবাই আমাকে এত ভয় কর কেন? এত সম্মান কর কেন? আমি তো এক হতভাগিনী। এতদিন ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে আমার সংসার করার কথা। তা না হয়ে তোমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি, পরছি, আবার এতবড় সংসারের দায়িত্বও বয়ে বেড়াচ্ছি।
সুরাইয়া বলল, বড় আপা, এসব কথা বলে আমাদের মনে আঘাত দিও না। তুমি যে আমাদের কাছে কতখানি তা আল্লাহপাক জানেন।
ওসব কথা থাক, কোনো দ্বিধা না করে আসল কথা বল।
এত ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি মাঝে মাঝে আসরের নামায পড়ে বাগানে বেড়াতে গিয়ে খালের দিকে যে দালান রয়েছে, সেখানে বসে চোখের পানি ফেল। এর কারণ জানতে চাই।
রুকসানা চমকে উঠে বলল, কে তোমাকে একথা বলেছে?
কে বলেছে বলব না, কথাটা যে সত্য তা অস্বীকার করতে পারবে?
রুকসানা কিছু না বলে তার মুখের দিকে কটমট করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
সে দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে সুরাইয়া মুখ নিচু করে বলল, আমার দৃঢ় ধারণা, তোমার জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে তুমি বিয়ে করতে চাও না। কথা শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে দেখল, যার কথা মতো এতবড় সংসার চলছে, যার কথা বাড়ির সবাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়, যাকে আব্বা আম্মা ছাড়া সবাই ভয় করে, সেই বড় আপা ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে আর তার বড় বড় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল বেয়ে টপ টপ করে পড়ছে। সুরাইয়ার মনে হল তার ধারণাই ঠিক। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের আঁচলে চোখ মুখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, নিজের দুঃখের কথা অন্যকে বললে, সম্পূর্ণ না হলেও দুঃখের বোঝা কিছুটা হালকা হয়। বড় আপা, আল্লাহর দোহাই লাগে, ঘটনাটা আমাকে বল। তুমি বিয়ে করতে রাজি হওনি বলে আব্বা, আম্মা ও আমরা সবাই খুব অশান্তি ভোগ করছি। যেদিন থেকে তোমার বিরহ অভিসারের কথা জেনেছি, সেদিন থেকে সেই অশান্তি আরো বেশি ভোগ করছি।
রুকসানা তার হাত ধরে বসিয়ে বলল, বলব, তবে তোমাকে ওয়াদা করতে হবে কাউকে বলবে না।
সুরাইয়া ওয়াদা করে বলল, এবার বল।