হোসেন স্যার বলল, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আমাকে অতবড় করে বলবেন না। কাজের ব্যস্ততায় কথা দিয়েও আসতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর হাসপাতালের ব্যাপারে যা প্লন প্রোগ্রাম করেছে বলে বলল, আমি আপনার সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করি। আব্দুল মতিন বললেন, নিশ্চয় পাবে। এমন মহৎ কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা সকলেরই উচিত। তবে মিটিং এ যাওয়ার কথা যে বললে, তা সম্ভব নয়। কারণটা তো দেখতেই পাচ্ছ।
এমন সময় কাজের মেয়ে করিমন চা-নাস্তা নিয়ে এলে আব্দুল মতিন মনিরাকে বললেন, তোর স্যারকে নাস্তা খাওয়া।
হোসেন স্যার কেন বসল না রুকসানা তা বুঝতে পেরেছে। তাই আব্বা যখন মনিরাকে নাস্তা খাওয়াতে বলল তখন ভাবল, হোসেন স্যার আব্বার সামনে বসে কিছুতেই নাস্তা খাবে না। আবার না খেলে আব্বা হোসেন স্যারকে দাম্ভিক ভাববে। তাই কি বলে আব্বাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ওষুধ খাওয়াবার কথা মনে পড়ল। ঘড়ি দেখে আব্বাকে সে কথা বলে বলল, তোমাকে নিয়ে যাই?
আব্দুল মতিন বললেন, একটু পরে যাবখন।
রুকসানা বলল, ওষুধ সময় মতো খেতে ডাক্তার বারবার বলে দিয়েছেন।
আব্দুল মতিন হোসেন স্যারকে বললেন, জান বাবা, এই মেয়েটা নিজে যেমন নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে তেমনি এ বাড়ির সবাইকে মেনে চলতে বাধ্য করে। কারো এতটুকু ক্ষমতা নেই ওর কথার অবাধ্য হয়। তুমি সময় করে মাঝে মাঝে এস।
রুকসানা বলল, আব্বা যেন কী? ওঁর সামনে এসব কথা বলছ কেন? তারপর হুইল চেয়ার ঠেলে আব্বাকে নিয়ে চলে গেল।
হোসেন স্যার চা-নাস্তা খেয়ে মনিরাকে বলল, এবার আসি।
মনিরা বলল, বড় আপার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাবেন? একটু বসুন, বড় আপাকে ডেকে নিয়ে আসি।
আবার যখন আসব তখন দেখা তো হবেই, এখন আর ডাকার দরকার নেই বলে হোসেন স্যার বিদায় নিয়ে চলে গেল।
মনিরা ভাবল, বড় আপা আসেনি বলে স্যার হয়তো মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ঐ কথা বললেন। হনহন করে আব্বার রুমে এসে তাকে না পেয়ে তার রুমে গেল।
রুকসানা ইচ্ছা করে হোসেন স্যারকে বিদায় দিতে যায়নি। মনিরা যা চালাক, কথা-বার্তা একটু এদিক ওদিক হলেই অন্য কিছু ভাবতে পারে। তাই আব্বাকে, ওষুধ খাইয়ে নিজের রুমে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সদরের দিকে তাকিয়েছিল হোসেন স্যারকে দেখার জন্য।
মনিরা রুমে ঢুকে তাকে দেখতে পেয়ে বলল, বড় আপা, স্যার চলে গেছেন। তুমি আব্বাকে ওষুধ খাইয়ে গেলে না কেন? স্যার কি মনে করলেন? আমি তোমাকে ডাকতে চেয়েছিলাম। স্যার নিষেধ করে বললেন, “আবার যখন আসব তখন তো দেখা হবেই।”
রুকসানা বলল, স্যার তো ঠিক কথাই বলেছেন, তুই না থাকলে বরং উনি কিছু মনে করতেন। আসরের আযান হয়ে গেছে। যা নামায পড়ে নে। আমিও পড়ব।
মনিরা আর কিছু বলতে না পেরে সেখান থেকে চলে গেল।
হোসেন ফিরে এসে রুকসানা ও তার মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছে সে সবের যতটা বলা সম্ভব, আসমা ও দাইহানকে বলে বলল, এখন তোমারাই চিন্তা কর, কিভাবে আমাদের মনের আশা পূরণ হতে পারে?
আসমা বলল, আমি আব্বাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাব।
হোসেন হেসে উঠে বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন? আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে। কোনো ধনী ও উচ্চ বংশের বাবা কী তাদের দারোয়ানের ছেলেকে জামাই করতে পারে?
আসমা বলল, আমারও তোমার ভাইয়ার তো প্রায় একই রকম ব্যাপার ছিল। রোকসানার আব্বাই যখন আমাদের ব্যাপারটা সমাধান করলেন, তখন নিজের মেয়ের বেলায় করবেন না কেন?
হোসেন বলল, মানুষ অপরের কোনো বিষয় সমাধান করে ঠিক; কিন্তু ঐ একই বিষয়ে নিজেরটা করে না। এটাই দুনিয়ার রীতি।
আসমা বলল, রুকসানা আমাকে আত্মঘাতী থেকে বাঁচিয়েছে। আমিও তার জন্য জানের বাজী রাখব। চৌধুরী চাচার পায়ে ধরে কেঁদে হলেও রাজি করাব।
হোসেন বলল, তা হয় না। আমি তোমাকে তা করতে দেব না। মুসলমান হিসাবে তকদিরকে বিশ্বাস করি। আর তকদির আল্লাহপাক লিখেছেন। তাই আমি তকদিরের উপর নির্ভর করে এতবছর যখন ধৈর্য ধরে আছি তখন বাকি জীবনটাও থাকব। তবু চৌধুরী বংশের এতটুকু অসম্মান করতে পারব না। শোনো, তুমি যদি আমার ও রুকসানার উপকার করতে চাও, তাহলে এই ব্যাপারে কোনো রকম তদবীর করবে না। ধৈর্য ধরে দেখ, আল্লাহ আমাদের কুদিরে কি লিখেছেন।
আসমা বলল, তকদীরের উপর বিশ্বাস করা যে প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর উপর ফরয, একথা জানি। কিন্তু তিনি তো তকূদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকতে বলেন। নি। বরং চেষ্টা করে তকুবীর করতে বলেছেন।
হোসেন বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু চেষ্টা তদবীরের সঙ্গে যেখানে মান সম্মান ও অসম্ভব কিছু জড়িত থাকে, সেখানে চেষ্টা তদবীর করা শুধু ভুল নয়, অন্যায়ও।
আসমা বলল, তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না। আর তুমি যতই নিষেধ কর না কেন, চেষ্টা তদবীর আমি করবই।
দাইহান এতক্ষণ চুপ করেছিল। স্ত্রী থেমে যেতে বলল, আসমা ঠিক কথা বলেছে। রুকসানা আমাদের যা উপকার করেছে, তার প্রতিদান হিসেবে, আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবই ইনশাআল্লাহ।
হোসেন ভাবল, এদেরকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। বলল, তোমরা যখন আমার কথা শুনবেই না তখন যা ইচ্ছা কর। কিন্তু মনে রেখ, যদি রুকসানার কিছু। হয়, তাহলে তোমাদের সঙ্গে চিরকালের জন্য সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।