হোসেন বলল, আমি জানি রুকসানা, তোমাদের বংশ মর্যাদা, তোমার বাবার মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে তুমি যেমন আমাকে গ্রহণ করতে পারবে না, একজন দারোয়ানের ছেলে হয়ে তোমাদের মান মর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে মালিক কন্যাকে গ্রহণ করতে আমিও পারব না। হয়তো ইহকালে আমাদের মিলন কুদিরে নেই। তাই বলব, এত বছর যখন আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি, আর কিছুদিন তারই উপর ভরসা করে ধৈর্য ধরে থাকি এস। তকদিরে মিলন থাকলে তিনিই কোনো না কোনো পথ দেখিয়ে দিবেন। আর না থাকলে সবর করে এভাবেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এত ভেঙ্গে পড়ছ কেন? জানত, ধৈর্যই সাফল্যের চাবি? এবার সংযত হও, তোমাকে নিয়ে তোমার আব্বার সঙ্গে দেখা করতে যাব।
রুকসানা সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে চোখে চশমা পরে বলল, আর একটু বস চা খেয়ে যাব।
প্রতিদিন অফিস ছুটির কিছুক্ষণ আগে রাবেয়া ও কায়সার কারখানার কাজ কর্ম সম্পর্কে রুকসানার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে। আজ রুমে ঢুকে অচেনা একজন ভদ্রলোককে দেখে দুজনেই সালাম দিল।
হোসেন সালামের উত্তর দিল।
রুকসানা তাদেরকে বসতে বলে বলল, পরিচয় করিয়ে দিই। হোসেনকে দেখিয়ে বলল, ইনি হোসেন স্যার ফুকরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংলিশের টিচার। শুধু তাই নয়, একজন ভালো হোমিও ডাক্তারও।
তারপর ওদের দুজনকে দেখিয়ে হোসেনকে বলল, এরা হল একে অপরের জীবনসাথী রাবেয়া ও কায়সার। আমরা তিনজনই এই কারখানার মালিক। তারপর মেয়ে পিয়ন আসিয়াকে ডেকে চা দিতে বলল।
চা খাওয়ার সময় কায়সার হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাল টিচার ও ডাক্তার হিসাবে আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। আজ পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। তারপর বলল, শুনলাম আপনি নাকি একটা হাসপাতাল করার জন্য চেষ্টা করছেন?
হোসেন বলল, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। তবে এতবড় কাজ আমার একার দ্বারা কি সম্ভব? তাই আশ-পাশের গ্রামের মানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতার আশা নিয়ে এই কাজে হাত দিয়েছি।
রুকসানা ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, সেই জন্য উনি আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আজ আর আমাদের আলাপ আলোচনা হবে না। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ছুটির সময় পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে। তোরা যা, আমি ওঁকে নিয়ে যাব।
রাবেয়া ও কায়সার বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর রুকসানা হোসেনকে বলল, চল আমরাও যাই।
যেতে যেতে রাবেয়া বলল, জান, কিছুদিন আগে ঐ ভদ্রলোক রুকসানাকে ষাড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন।
কায়সার বলল, তাই নাকি? ঘটনাটা বলত?
রাবেয়া ঘটনাটা বলে বলল, রুকসানার কথাবার্তায় মনে হল, ভদ্রলোকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
কায়সার বলল, কই আমিতো তেমন কিছু আভাস পেলাম না।
তুমি না পেলেও আমি পেয়েছি।
দেখা যাক সময় কি বলে।
৭. বছর পাঁচেক আগে স্ট্রোক করে
বছর পাঁচেক আগে স্ট্রোক করে আব্দুল মতিনের ডান হাত ও পা প্যারালাইজ হওয়ার পর একা নিচে নামতে পারেন না। তাই লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্যে উপরের তলাতে একটা ড্রইংরুম করেছেন। যারা দেখা করতে আসেন, তাদেরকে প্রথমে নিচের তলার ড্রইংরুমে বসিয়ে, আব্দুল মতিনকে খুরর দেওয়া হয়। উনি হুইল চেয়ারে করে উপরের ড্রইংরুমে আসার পর লোকজনকে উপরে নিয়ে আসা হয়।
রুকসানা হোসেন স্যারকে নিচের ড্রইংরুমে বসিয়ে উপরে গিয়ে আব্বাকে বলল, হোসেন স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
আব্দুল মতিন আনন্দিত হয়ে বললেন, কোথায় বসিয়েছিস?
নিচের ড্রইংরুমে।
যা উপরে নিয়ে আয়, আমি আসছি।
রুকসানা আব্বার রুম থেকে বেরিয়ে মনিরাকে দেখতে পেয়ে বলল, হোসেন স্যার নিচে বসে আছেন, উপরে নিয়ে আয়।
মনিরা চলে যাওয়ার পর রুকসানা সুরাইয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকল।
সুরাইয়া কিচেনে যাবে ভাবছিল? বড় আপার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল।
রুকসানা বলল, হোসেন স্যার এসেছেন, আরেফা ও মমতাজকে নিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা কর। তারপর আব্বার রুমে ফিরে এল।
আজিজা বেগম স্বামীর ড্রেস পাল্টে দিচ্ছিলেন। বললেন, স্যারকে উপরে এনেছিস?
রুকসানা বলল, মনিরাকে পাঠিয়েছি। এতক্ষণে হয়তো নিয়ে এসেছে।
মনিরা নিচে এসে স্যারকে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।
হোসেন স্যার মনিরার সঙ্গে উপরের ড্রইং রুমে এসে বসেছে, এমন সময় রুকসানা আব্বার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে ঢুকল।
হোসেন স্যার সালাম দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ওঁর এই অবস্থার কথা মনিরা বা রুকসানা তো জানায় নি?
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে বললেন, মনে হচ্ছে, আপনি আমার এই অবস্থার কথা জানতেন না?
হোসেন স্যার দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, জি না জানতাম না। তারপর বলল, বেয়াদবি নেবেন না, বিশেষ কারণে আমি বসতে পারছি না। আর আমি আপনার ছেলের বয়েসি, আমাকে তুমি করে বলুন।
আব্দুল মতিন বললেন, ঠিক আছে। তারপর বললেন, তুমি আমার মেয়েকে খুব বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। সেজন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বিপদের ঘটনা শোনার পর তোমাকে দেখার জন্য রুকসানাকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। অনেক পরে এলেও আমি খুশি হয়েছি। মানুষের কল্যাণের জন্য তুমি যা কিছু করছ, তার কিছু কিছু আমি শুনেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, “তিনি যেন তোমাকে আরো মানুষের কল্যাণকর কাজ করার তওফিক দিন।” তোমার মতো ছেলে প্রতি গ্রামে জন্ম। নিলে দেশের অনেক উন্নতি হত।