রুকসানা চমকে উঠতে গিয়েও সামলে নিল। বলল, আসতে বল।
হোসেন পর্দা ঠেলে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর বসতে বলে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তখন তার হার্টবিট বেড়ে গেল।
হোসেন বসে মৃদু হেসে বলল, কী দেখছেন?
রুকসানা সামলে নিয়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ব্যথা সারার ওষুধ দিয়ে। গিয়েছিলেন, এতদিন পরে সারল কিনা খোঁজ নিতে এসেছেন বুঝি?
ঠাট্টা করছেন?
যদি তাই মনে করেন, তাহলে তাই। কী দেখছিলেন, বললেন না যে?
হাদিসে আছে, “মানুষের মুখটা হল দীলের আয়না।” দীলে কি আছে মানুষের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়।
আমারটা কী বুঝলেন?
আপনি খুব শক্ত দীলের মানুষ, তাই বুঝতে পারিনি। যাক গে, ঢাকা থেকে ফিরলেন কবে?
গতকাল।
জরুরী ওষুধ কিনতে আটদিন সময় লাগে, তা আমার জানা ছিল না।
অন্য একটা জরুরী কাজে আটকা পড়েছিলাম।
কাজটা বলতে অসুবিধা আছে?
না নেই। বলছি শুনুন, আমি একটা হাসপাতাল করার চেষ্টা করছি। সে ব্যাপারে মিটিং-এ স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য তার কাছে ছুটাছুটি করতে হয়েছে।
তাই নাকি? শুনে খুশি হলাম। তা স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসবেন?
মিটিং-এ আসতে পারবেন না। তবে হাসাপাতাল উদ্বোধন করতে আসবেন। মিটিং-এ আসার জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার আব্বাকেও জানাব।
ইনশাআল্লাহ আসব। এবার দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
করুন।
দাইহান ও আসমাকে চেনেন?
চিনি।
কতটা চেনেন?
দাইহান ফজল সেখের ছেলে, আর আসমা গেঁদু মুন্সীর মেয়ে। বর্তমানে তারা স্বামী-স্ত্রী। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। আরো কিছু বলা লাগবে?
ওদের সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা আছে?
গ্রামের সকলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। তবে পাশা-পাশি বাড়ি হিসাবে ওদের সঙ্গে একটু বেশি আর কি। এবার আমি একটা কথা বলব, মাইণ্ড করবেন না বলুন?
না, বলুন কী বলবেন।
অনেকে রোদের কারণে সানগ্লাস পরে, আপনি রুমের ভিতর পরেন কেন?
রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আমার চোখের অসুখ। তাই ডাক্তার সব সময় সানগ্লাস পরে থাকতে বলেছেন।
ডাক্তার হিসাবে আমি যদি আপনার চোখটা একটু পরীক্ষা করতে চাই, তাহলে কি অন্যায় হবে?
না হবে না, তবে আমি আপনাকে চোখ দেখাব না।
কেন?
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এবার নিশ্চয় পারবেন বলে রুকসানা যে চিঠিটা আসমাকে দিয়েছিল সেটা পকেট থেকে বার করে হোসেন টেবিলের উপর তার সামনে রাখল।
রুকসানা চিঠিটা দেখেই চমকে উঠে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এক সময় সানগ্লাসের পাশ দিয়ে গাল বেয়ে চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগল।
হোসেন তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তারও চোখে পানি আসার উপক্রম হল। সামলে নিয়ে ভিজে গলায় বলল, আমাকে মনে রেখে এত কষ্ট সহ্য করা তোমার উচিত হয়নি। ছেলেবেলায় ছেলেমানুষি খেয়ালে যে অন্যায় করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি পেয়েছিলাম। তাই সেই সময় তোমাকে দায়ী ভেবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেমন করে হোক তোমাকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নেব। বড় হওয়ার পর। আল্লাহ যখন মেহেরবানী করে ধর্মীয় জ্ঞান দিলেন তখন সেই প্রতিজ্ঞা মন থেকে দূর করে দিই। তবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম, “তোমার উপযুক্ত হওয়ার তওফিক যেন তিনি আমাকে দেন এবং তোমাকে আমার জন্য কবুল করেন।” তাই এত বছর। কষ্ট করে সাধনা করে এতদূর পৌঁছেছি। তারপর গ্রামে এসে আত্মগোপন করে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখন আসমার কাছে জানতে পারলাম তুমি আমার জন্য অপেক্ষায় আছ তখন খুব আনন্দিত হলেও বিশ্বাস করিনি। কাল আসমা যখন এই চিঠি দিল তখন পড়ে আনন্দ পেয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়েছি। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তাই আজ না এসে থাকতে পারলাম না। আল্লাহপাকই জানেন এর পর কি হবে। যেদিন পথে তোমাকে আঁড় তাড়া করেছিল, সেদিন তোমাকে দেখেই আমি চিনেছি। তুমি হয়তো চিনতে পারনি। আসমার মুখে তোমার সব কথা শোনার পর সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য তোমার কাছে ছুটে আসতে মন চেয়েছিল, কিন্তু আসিনি। আসমা ও দাইহানকেও আমার কথা তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছি। তাই আসমা তোমার চিঠির উত্তর দিতে পারেনি। যে বুকভরা আশা নিয়ে এসেছিলাম, তা আল্লাহর দয়ায় সত্য প্রমাণিত হল। কিন্তু সেই আশা সফল হওয়ার কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না। তুমি যদি পেয়ে থাক বল।
হোসেন স্যারের কথা শুনতে শুনতে রুকসানার চোখ থেকে আরো বেশি পানি পড়ছিল। সে থেমে যেতে প্রথমে মুখের নেকাব সরাল। তারপর সানগ্লাস খুলে চোখ মুখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আল্লাহর কসম, তখন আমার সেক্স সম্পর্কে কোনো জ্ঞান হয়নি। তাই আম্মা যখন বুকে তেল মালিশ করে দিচ্ছিল তখন ব্যথা পেয়ে উহ করে উঠেছিলাম। মা ব্যথার কারণ জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম, তুমি বুকে হাত দিয়েছিলে। এই কথায় আম্মা যে আব্বাকে দিয়ে তোমাকে ঐরকম শাস্তি দেওয়াবে, তা যদি জানতাম, তাহলে কিছুতেই বলতাম না। তোমাকে যখন শাস্তি দেয় তখন আমি গাছের আড়াল থেকে দেখেছি। তখন মনে হয়েছে তোমার গায়ে যতগুলো চাবুক পড়েছে তার সবগুলো আমার গায়েও পড়েছে। সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গাছতলায় পড়েছিলাম আব্বা কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। সেই থেকে তোমার স্মৃতি আজ ও আমার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, আমিও তো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।