ইকবাল বলল, কই আমি তো তার কোনো চিঠি পাইনি। তারপর বলল, গ্রাম দেশে অনেক চিঠি মার যায়। কাজের চাপে আমিও আর যেতে পারিনি। এবারে ফিরে গিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।
সেখানে ফরিদা ছিল। স্বামীকে কী যেন ইশারা করল। খালেক বুঝতে পেরে বলল, আমরা তোমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলতে তুমি বলেছিলে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবে। সে ব্যাপারে কতদূর কি করলে? তোমার বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে।
ইকবাল চাচির ইশারা দেখে ফেলে, তারপর চাচার কথা শুনে বুঝতে পারল, তারা তাকে জামাই করার আশা এখনো ছাড়েনি। বলল, আব্বা আম্মার নামে একটা হাসপাতালের কাজে হাত দিয়েছি। সেটা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তারপর যা করার করব।
খালেক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, কি জানি বাবা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেন যে সময় মতো বিয়ে করতে চায় না, তা তারাই জানে।
ইকবাল দুদিন পরে ফিরে যাবে মনে করেছিল। কিন্তু মিটিং এ স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেক্রেটারিয়েটে বেশ কয়েকদিন ছুটাছুটি করতে হল। তবু মিটিংএ আনার ব্যবস্থা করতে পারল না। তবে উনি কথা দিয়েছেন, হাসপাতাল উদ্বোধন করতে যাবেন।
.
এদিকে পরের দিন মনিরা স্কুল ছুটির পর বান্ধবী জয়তুন ও তার মামাতো বোন আনোয়ারাকে নিয়ে বাড়িতে এল।
আলাপ পরিচয় ও আপ্যায়নের পর রুকসানা আনোয়ারাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি গেঁদু মুন্সীকে চেন?
আনোয়ারা বলল, আমাদের ঘর থেকে ওনাদের ঘর দূরে। তবু চিনি। তারপর হেসে ফেলে বলল, ছেলেবেলায় রাস্তায় দেখলে আমরা কিরপীন চাচা বলে দৌড়ে পালিয়ে যেতাম।
ওঁর মেয়ে আসমাকে চেন?
জ্বি বড় আপা, আসমা আপাকে সব মেয়েরাই চিনে। উনি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদেরকে তবলীগ করেন। কুরআন ও নামায পড়া শেখান। আমিও শিখি।
রুকসানা একটা মুখ বন্ধ খাম তার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার আসমা আপাকে দিয়ে বলবে, সেও যেন এরকম একটা খাম তোমার হাতে দেয়। দিলে তুমি স্কুলে মনিরাকে দিও। তাহলে আমি পাব। তারপর বলল, তোমরা গল্প কর আমি যাই।
বড় আপা চলে যাওয়ার পর মনিরা ওদেরকে বলল, আসমা আপা বড় আপার সই। অনেক দিন খোঁজ খবর পাইনি তাই চিঠি দিল।
ফেরার পথে আনোয়ারা জয়তুনকে বলল, আচ্ছা আপা, মনিরার বড় আপা ঘরের ভিতরেও সানগ্লাস পরেছিল কেন?
জয়তুন বলল, আমি জানব কি করে? তোর মতো আমিও আজ প্রথম ওদের ঘরে গেলাম। আমার মনে হয়, ওনার চোখে কোনো ডিফেক্ট আছে।
আনোয়ারা বলল, তোমার অনুমান বোধ হয় ঠিক। আমারও তাই মনে হয়েছে। তারপর বলল, ওরা খুব বড়লোক তাই না আপা?
জয়তুন বলল, হ্যাঁ। আব্বার মুখে শুনেছি, ওদের পূর্বপুরুষরা নাকি জমিদার ছিল।
ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল বলে জয়তুন আনোয়ারাকে ঘরে যেতে দিল না।
পরের দিন স্কুল থেকে ঘরে ফেরার পথে আনোয়ারা আসমাদের ঘরে গিয়ে খামটা তার হাতে দিয়ে বলল, এটা মনিরা আপার বড় আপা আপনাকে দিয়েছে।
বিয়ের পর আসমা মাঝে মধ্যে রুকসানাকে ডাকে চিঠি দেয়। রুকসানাও উত্তর দেয়। বছরে দু’একবার স্বামীকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে। বছর খানেক হল ইকবাল ভাই আসার ফলে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। তাই যোগাযোগ রাখতে পারেনি। মনিরাকে আসমা চিনে। আনোয়ারার কথা শুনে বলল, তোমাকে কী মনিরা এটা দিয়েছে?
আনোয়ারা বলল, না। আমার ফুপাতো বোন জয়তুন আপা মনিরা আপার বান্ধবী। জয়তুন আপা ও আমি কাল মনিরা আপাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এক সময় মনিরা আপার বড় আপা এই খামটা দিয়ে বললেন, আপনিও যেন এরকম একটা খাম আমার হাতে দেন এবং আমিও যেন সেটা স্কুলে মনিরা, আপাকে দিই।
আসমা বলল, ঠিক আছে, তুমি কাল স্কুলে যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।
তাই নিয়ে যাব। এবার আসি আপা বলে আনোয়ারা চলে গেল।
আসমা খামটা খুলে চিঠিটা পড়ল।
সই,
আশা করি, আল্লাহর রহমতে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছিস। অবশ্য। আমার কামনাও তাই। মনে হয় আমাকে ভুলে গেছিস। তা না হলে এক বছরের। মধ্যে একটা চিঠি দিয়েও খোঁজ নিলি না কেন? যাই হোক, কর্মব্যস্ততায় আমার দিন একরকম কেটে যাচ্ছে। তবে রাতের একাকীত্ব বড় পীড়া দেয়। আর ইকবালের কথা। মনে পড়লে সেই পীড়া হাজারগুণ বেড়ে যায়। যাকে বার তের বয়সের পর থেকে। আজ বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত একবার চোখের দেখাও দেখলাম না। তার স্মৃতি কেন। আমাকে এত পীড়া দেয় বলতে পারিস? সেই স্কুল লাইফ থেকে তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য তুই আমাকে অনেক উপদেশ দিয়ে বুঝিয়েছিস। আমিও অনেক সময় চিন্তা করেছি যার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি সে তো জানে না, আমি তাকে কত ভালবাসি, তার অপেক্ষায় জীবন যৌবন পার করে দিচ্ছি। সে হয়তো বিয়ে করে স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে। তবু কেন যে তাকে ভুলতে পারিনি, তা আমি নিজেই জানি না। এটাই আমার তকৃদিরের লিখন ভেবে মনকে বোধ দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। মনের আবেগে অনেক কিছু লিখলাম। এবার আসল কথায় আসি।
ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হোসেন স্যার নামে ঢাকার এক ভদ্রলোক নাকি কাজেম চাচার ভিটেয় দু’কামরা ঘর তুলে বসবাস করছেন। আর ডাক্তারখানা খুলে। গবিরদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছেন। ব্যাপারটা আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না। অবশ্য কিছু দিন আগে হঠাৎ একদিন দৈব দুর্ঘটনার মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। চিঠিটা বড় হয়ে যাবে ভেবে দুর্ঘটনাটা লিখলাম না। তোর চিঠি পাওয়ার পর জানাব। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি ভেবে পরের দিন কারখানায় এসে ওষুধ দিয়ে যান। সেই সময়। তাকে ছুটির পরে স্কুলে মনিরাকে পড়াবার ব্যবস্থা করি; কিন্তু উনি যে পরিচয় আমাকে দিয়েছেন এবং লোক মুখে যা কিছু শুনেছি তাতে ওঁকে ইকবাল বলে সন্দেহ হচ্ছে। তোদের ঘর যখন ওঁর ঘরের কাছে তখন নিশ্চয় তুই ও দাইহান ভাই ওঁকে। ভালোভাবে জেনেছিস? যা জেনেছিস দু’কলম লিখে পত্রবাহকের হাতে দিলে আমি পাব। একটা কথা জেনে রাখ, আমি এইট্টি পারসেন্ট সিওর, হোসেন স্যারই ইকবাল। কালকেই উত্তর দেওয়া চাই।