আজ যখন সবাই একসঙ্গে খাওয়ার টেবিলে এসে বসল তখন রুকসানা বলল, কাল পলাশপুরের আমাদের কারখানার একজন অসুস্থ শ্রমিককে চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর ফেরার পথে বিপদে পড়ার ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা বলে বলল, যিনি আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তার সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, তিনি মনিরাদের স্কুলে ইংলিশের টিচার। ঘরে এসে শুধু আব্বা আম্মাকে কথাটা বলেছিলাম। পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছি মনে করে আজ ওষুধ নিয়ে আমাদের কারখানায় এসেছিলেন। আলাপ করে জানতে পারলাম উনি টিচারীর সাথে সাথে হোমিও প্র্যাকটিস করেন। যাই হোক, এক সময় আমি তাকে মনিরাকে পড়াবার কথা বলি। প্রথমে সময়ের অজুহাত দেখালেও পরে ছুটির পর ঘণ্টাখানেক পড়াতে রাজি হয়েছেন। তারপর মনিরার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল থেকে ওঁর কাছে পড়বি। সামসু চাচা তোর জন্য অপেক্ষা করবে। সামুস মনিরাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যায় ও নিয়ে আসে।
আব্দুল মতিন রুকসানার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল বললাম না, দেখা হলে নিয়ে আসবি? দ্রলোক তোকে কত বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলেন, তাকে কৃতজ্ঞতা
জানান আমাদের উচিত।
রুকসানা বলল, আসতে বলেছিলাম, বললেন, “আজ সময় নেই অন্য দিন আসবেন।”
এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না, খাওয়া দাওয়ায় মন দিল।
পরের দিন হোসেন ক্লাস নিতে এসে মনিরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমার আপা তোমাকে কিছু বলেছেন।
জ্বি, ছুটির পর আপনার কাছে পড়তে বলেছেন।
ছুটির পর ক্লাসেই থেক কেমন?
জ্বি, থাকব।
প্রায় দিন পনের পর পড়ার সময় মনিরা বলল, আপনি যেদিন বড় আপার কারখানায় গিয়েছিলেন, সেদিন তাকে বলেছিলেন, একদিন আমাদের বাড়িতে যাবেন। যান নি কেন?
হোসেন বলল, সেকথা কী তোমার বড় আপা তোমাকে বলেছেন?
আমাকে বলেননি। ঐ দিন রাত্রে খাওয়ার সময় বাড়ির সবার সামনে বলেছে। আমিও সেখানে ছিলাম। আজ আব্বা বললেন, “তোর স্যারকে আমার কথা বলে আসতে বলবি।”
হোসেন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সময় করে উঠতে পারিনি। সকাল বিকাল রুগীর খুব ভীড় থাকে। ঠিক আছে, তোমার আব্বাকে বলো শুক্রবার সকালে যাব।
মনিরা ঘরে ফিরে স্যারের আসার কথা আম্মা-আব্বা ও বড় আপাকে জানাল।
শুনে রুকসানা ভাবল, হোসেন স্যার ইকবাল কিনা আমি চিনতে না পারলেও আব্বা হয়তো পারবে। যদি চিনতে পারে, তাহলে আব্বা কি করবে ভেবে বেশ চিন্তিত হল।
বৃহস্পতিবার পড়াবার সময় হোসেন মনিরাকে বলল, অত্যন্ত জরুরী কিছু ওষুধ কেনার জন্য কাল সকালে আমি ঢাকা যাব। তাই তোমাদের বাড়িতে যেতে পারব না। তোমার আব্বাকে বলো, কথা দিয়ে রাখতে পারলাম না, তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন।
মনিরা বলল, শনিবার ঢাকা গেলে হয় না স্যার?
না হয় না। ওষুধগুলো মুমূর্ষ রুগীর। যে কোনো সময়ে দরকার হতে পারে। ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ এই গুরুত্বের কথা বুঝবে না।
তাহলে কবে যাবেন বলুন?
এবার আর নির্দিষ্ট তারিখ দিতে পারব না। দেখলে তো, একবার দিয়ে রাখতে পারলাম না। তাই আর কবে যাব ওয়াদা করব না। তবে ইনশাআল্লাহ একদিন যাব।
ঘরে এসে মনিরা কথাটা প্রথমে আব্বা আম্মাকে জানাল। তারপর বড় আপার রুমে এসে তাকেও জানাল।
কথাটা শুনে রুকসানা ভাবল, আব্বা চিনে ফেলতে পারে ভেবে এলেন না? না সত্যিই জরুরী ওষুধ কিনতে ঢাকা যাবেন? মনিরাকে চলে যেতে দেখে বলল, এই শোন।
মনিরা ফিরে এসে বলল, কি বলবে তাড়াতাড়ি বল, খুব খিদে পেয়েছে।
তোদের ক্লাসে দক্ষিণ ফুকরার কোনো মেয়ে পড়ে না?
আমাদের ক্লাসে পড়ে না, তবে আমার বান্ধবীর মামাতো বোনের বাড়ি দক্ষিণ ফুকরায়। সে এইটে পড়ে।
তোর বান্ধবীকে ও তার মামাতো বোনকে একদিন নিয়ে আসিস তো।
কেন বড় আপা?
কেন আবার, দরকার আছে।
ঠিক আছে নিয়ে আসব, এবার যাই?
যা।
মনিরার সব কিছু বোঝার মতো জ্ঞান হয়েছে। যেতে যেতে ভাবল, হোসেন স্যার আসবে শুনে বড় আপার মুখে আনন্দের আভা দেখেছিলাম। আজ আসবে না শুনে মুখটা মলিন হতে দেখলাম। তাহলে কি স্যারের প্রতি বড় আপা….., ছিঃ ছিঃ বড় আপাকে নিয়ে একি ভাবছি? চিন্তাটা দূর করে দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, খেতে দাও।
মনিরা শনিবার স্কুলে গিয়ে বান্ধবী জয়তুনকে বলল, আমি তোদের বাড়িতে কতবার গেছি? তুই যাবি যাবি করে একদিনও গেলি না। আজ যাবি।
জয়তুন বলল, ছুটির পর তুই হোসেন স্যারের কাছে পড়িস। তারপর গিয়ে ফিরে আসতে রাত হয়ে যাবে না?
তুই যেতে চাইলে আজ পড়ব না। কী যাবিতো?
আজ নয় কাল যাব।
কেন আজ গেলে কি হয়?
বারে, মাকে বলে আসতে হবে না?
তাহলে কাল যাবি তো?
হ্যাঁ যাব। সঙ্গে আনোয়ারাকেও নেব। তা না হলে ফেরার সময় একা একা খারাপ লাগবে। আজ ওকে বলে দেব, কাল আসার সময় বাড়িতে যেন বলে আসে, কাল আমাদের বাড়িতে থাকবে।
.
ইকবাল প্রায় এক বছরের মতো হল গ্রামের বাড়িতে এসেছে। এর মধ্যে একবারও ঢাকায় না গেলেও শত ব্যস্ততার মধ্যে খালেক চাচাকে মাঝে মধ্যে চিঠি দিয়েছে। খালেকও চিঠির উত্তর দিয়েছে। মালেকার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ফরিদপুর গিয়েছিল। সে সময় একমাস কলেজ বন্ধ থাকায় মালেকা ঢাকায় চলে গিয়েছিল। তাই তার সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে সময়ের অভাবে আর যেতে পারেনি। এবারেও ওষুধ কিনতে ঢাকায় এসে খালেক চাচার বাড়িতে উঠল। এক সময় খালেক। বলল, মালেকা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, সে যখন ছুটিতে এখানে ছিল তখন তুমি নাকি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে। যাওয়ার সময় তোমার ঠিকানা নিয়ে গেছে তোমাকে চিঠি দেবে বলে। দিয়েছিল চিঠি?