সে কি? এখনো বিয়ে করেনি?
তাহলে ঐ কথা বললাম কেন?
তুমি তার সম্পর্কে কতটা জান?
শুধু তার সম্পর্কে নয়, আমাদের দুজনের মধ্যে এত গভীর সম্পর্ক যে, একে অপরের কাছে কোনো কিছু গোপন নেই। তাই আমার জীবনে ঝড় তুফানের কথা সে যেমন জানে। আমিও তার জীবনের ঝড় তুফানের কথা জানি। রুকসানা যদি আমার ঝড় তুফানে হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে তোমার দাইহান ভাইকে পেতাম না। বিষ খেয়ে জীবন দিতে হত। এই যে সুখের সংসার দেখছ, তা স্বপ্নই থেকে যেত। তারপর রুকসানা কিভাবে তাকে সাহায্য করেছিল বলে বলল, যে আমাকে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপ থেকে বাঁচাল, যে আমার স্বপ্নকে সফল করল, তার জন্য এতদিন কিছু করার অপেক্ষায় ছিলাম। নামায পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম “আল্লাহ গো, আমার সই যেমন তোমার দয়ার আমার স্বপ্নকে সফল করিয়েছে, তোমার দয়ায় আমিও যেন তার স্বপ্ন সফল করাতে পারি, সেই সুযোগ আমাকে দাও।”
আল্লাহ এতদিনে আমার দোয়া কবুল করেছেন। তাই তুমি এসেছ। পনের ষোল বছর আগে যখন তুমি এসেছিলে তখন সেকথা আমার মুখে শুনে রুকসানার মুখে যে আনন্দের ঝলক দেখেছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তারপর আমাকে দিয়ে তোমাকে দেখা করতে বলেছিল। তুমি না গিয়ে যে কথা বলেছিলে, সেকথা শুনে তার মুখে যে বেদনার ছাপ ফুটে উঠতে দেখেছিলাম, তাও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, আল্লাহর কসম করে বলত, রুকসানার কথা তুমি ভুলে গেছ?
আসমার কথা শুনতে শুনতে হোসেনের মনে আনন্দের বান ডাকতে শুরু করেছে। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তার কথা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভুলতে পারব না।
তাহলে আমার ভাবা কি অন্যায় হবে। তার জন্যেই আজও তুমি বিয়ে করনি?
না অন্যায় হবে না, বরং সেটাই সত্য।
আল হামদুলিল্লাহ বলে আসমা বলল, আজই আমি রুকসানাকে নিয়ে আসার জন্য ইব্রাহীমের আব্বাকে পাঠাব।
হোসেন বলল, এত ব্যস্ত হয়ো না। তুমি যখন আমাদের সবকিছু জান, তখন তোমার কাছে কোনো কিছু গোপন করব না। যা বলছি মন দিয়ে শোন, এখন এসব কথা এতটুকু চিন্তা করো না। যখন সময় হবে তখন আমিই তোমাকে বলব। আল্লাহ রাজি থাকলে তোমার আমার ও রুকসানার স্বপ্ন একদিন সফল হবেই। তারপর জিজ্ঞেস করল, দাইহান ভাই কী আমার ও রুকসানার ব্যাপারটা জানে?
হ্যাঁ জানে। আমি তাকে একদিন তোমাদের দুজনের সব কথা বলে ঢাকায় খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বিনা ঠিকানায় অতবড় শহরে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তাই কয়েকদিন পরে বিফল হয়ে ফিরে আসে।
এখন দাইহান ভাইকে কিছু বলো না।
কিন্তু সে যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে?
করলে সংক্ষেপে আমার মতামত জানাবে।
মেয়ের কান্না শুনে আসমা বলল, যয়নাব দোলায় ঘুমিয়েছিল। উঠে পড়েছে। কথা বলতে বলতে চায়ের কথা ভুলে গেছি। কথা শেষ করে আসমা চলে গেল। একটু পরে যয়নাবকে কোলে নিয়ে চা হাতে করে ফিরে এল।
৬. ইকবাল আজ আট-দশ মাস
ইকবাল আজ আট-দশ মাস হতে চলল হোসেন স্যার নামে পরিচিত হয়ে ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। স্কুলে জয়েন করার পর সেক্রেটারীর সদরে মাস দুয়েক থেকে নিজের ভিটেয় দুইরুমের বাড়ি করে সেখান থেকে চলে এসেছে। তারপর শিক্ষকতার সাথে সাথে ডাক্তারী শুরু করেছে। বাড়ি করার সময় গ্রামের লোকজন আপত্তি করে বলেছিল, ঢাকার লোক গ্রাম দেখতে এসে ফুকরা মেয়েদের। স্কুলে মাস্টারী করত, সেখানে থাকত, ভালো কথা। কিন্তু মরহুম কাজেম সেখের। ভিটেয় বাড়ি করবে কেন? তখন ফজল সেখ ও গেঁদু মুন্সী তাদেরকে বলেছেন, উনি শুধু শিক্ষিত নন, একজন বড় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারও। গ্রামের গরিবদের অসুখ বিসুখে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবেন। পরে জমি-জায়গা কিনে একটা হাসপাতালও করবেন। সেখানেও গরিবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করা হবে। আর উনি যে আমাদের মসজিদ পাকা করে দিয়েছেন, তা তো আপনারা জানেন। তাছাড়া উনি ফজলের কাছে স্টাম্পের উপর লিখে দিয়েছেন, মরহুম কাজেমের ছেলে যদি কখনও ফিরে আসে, তাকে তার বাপের ভিটে ছেড়ে দেবেন।
এই কথা শোনার পর গ্রামের লোকজন আর কোনো আপত্তি করেনি।
ইন্টারভিউ নেয়ার পর স্কুল কমিটি যখন ইকবালকে সিলেক্ট করল তখন সে হেড মাস্টারকে চুপি চুপি বলল, সার্টিফিকেটে আমার পুরো নাম ইকবাল হোসেন আছে। আমি সবার কাছে শুধু হোসেন নামে পরিচিত হতে চাই।
লতিফ স্যার মৃদু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে এর পিছনে কোনো কারণ আছে?
ইকবালও মৃদু হেসে বলেছিল, আপনার অনুমান ঠিক।
স্কুলে ও আশ-পাশের গ্রামের লোকজনের কাছে ইকবাল যেমন হোসেন স্যার নামে পরিচিত তেমনি একজন ভালো শিক্ষক ও ভালো ডাক্তার হিসেবেও প্রশংসিত। গরিবরা হোসেন ডাক্তারকে আল্লাহর রহমত মনে করে।
গতকাল পাশের গ্রাম থেকে একটা বুড়ো রুগীকে দেখে ফেরার সময় হোসেন স্যার রুকসানাকে যখন ষাড়ের কবল থেকে রক্ষা করেছিল তখন তার মুখ দেখেই চিনতে পেরেছিল। তাই আজ ওষুধ দেওয়ার অসিলায় আলাপ করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে চিন্তা করল, এত বছর না দেখার ফলে গতকাল রুকসানা আমাকে। চিনতে পারেনি। আজ আব্বার ভিটেয় ঘর করে আছি শুনে চমকে উঠেছিল। তাছাড়া আলাপের সময় যেসব কথা বলেছি; আশা করি মনে সন্দেহ জাগাতে সক্ষম হয়েছি। দেখা যাক আল্লাহর কি মর্জি।