আসমা বলল, ইকবাল ভাই, তুমি নিশ্চিত থাক, আমি সবাইকে ম্যানেজ করব।
ইকবাল আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আর একটা কথা, আমার পুরোনাম ইকবাল হোসেন, এখন থেকে হোসেন বলে ডাকবেন। ভুলেও ইকবাল নামে ডাকবেন না।
সবার আগে আসমা বলল, এব্যাপারেও ও আমি সবাইকে সামলাব।
এমন সময় এশার আজান হতে গেঁদু মুন্সী বলল, চলো সবাই মসজিদে যাই।
যেতে যেতে ইকবাল বলল, মসজিদের অবস্থা দেখে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। গ্রামে এতলোক বাস করে, মসজিদের দিকে কারো লক্ষ্য নেই। আল্লাহ রাজি থাকলে আব্বা আম্মার রুহের মাগফেরাতর জন্য সবকিছুর আগে মসজিদটা পাকা করব।
দাইহান বলল, তুমি খুব সুন্দর কথা বলেছ। তুমি শুরু কর, আমরাও যতটা পারি সাহায্য করব।
নামায পড়ে ইকবালকে নিয়ে দাইহান ফিরে এলে আসমা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি ইকবাল ভাইকে, থুড়ি, হোসেন ভাইকে নিয়ে গল্প কর। রান্না এখনো শেষ হয়নি। হলে খাওয়ার ব্যবস্থা করব।
দাইহান হেসে বলল, তখন তুমিই সব কিছু সামলাবে বলে নিজেই এখন ভুল করে ফেললে।
হোসেন বলল, প্রথম প্রথম সবারই এরকম ভুল হয়।
পরের দিন সকালে দাইহান পান্তা খেয়ে স্ত্রীকে বলল, আমি কামলাদের নিয়ে ক্ষেতে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হতে পারে। হোসেন ফিরলে নাস্তা খাইয়ে দিও।
আসমা বলল, হোসেন ভাই কোথায়?
সে নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে বলল, প্রতিদিন সকালে ঘণ্টা খানেক হাঁটা তার অভ্যাস। হাঁটতে গেছে।
ঠিক আছে, আমি নাস্তা বানাই, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো।
হোসেন হাঁটতে হাঁটতে ফুকরা গ্রামে এসে একজনকে হেড মাস্টার লতিফ স্যারের বাড়ি কোনখানে জিজ্ঞেস করল।
লতিফ স্যারও ফজরের নামায পড়ে প্রতিদিন কিছুক্ষণ হাঁটেন। আজও হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফেরার সময় গতকালের বাসে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাকে একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, এত সকালে আপনি?
হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, প্রতিদিন ভোরে হাঁটা আমার অভ্যাস। তাই হাঁটতে হাঁটতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম, কয়েকটা কথা বলব বলে।
লতিফ স্যার বললেন, আমিও প্রতিদিন ভোরে হাঁটি। চলুন বাসায় গিয়ে আলাপ করি।
লতিফ স্যারের বাড়ি চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে। উনি প্রায় পনের বছর ফুকরা বালিকা। উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন। স্কুল থেকে অল্প দূরে বিঘে খানেক। জমি কিনে বাড়ি করে সপরিবারে থাকেন। ওঁর স্ত্রী ও ফুকরা সরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। তাদের দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুটো হাইস্কুলে আর মেয়েটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। পুরো বাস্তুটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ির চার পাশে। সুপারী ও অন্যান্য ফলের গাছ। দুই রুমের টিন সেড বাড়ি। একটা বেড়ার বৈঠকখানা। বেশ ছিমছাম পরিবেশ।
লতিফ স্যার হোসেনকে সঙ্গে করে বৈঠকখানায় এসে বসতে বলে বললেন, আমি একটু আসছি।
হোসেন বলল, স্যার, কিছু মনে করবেন না। যদি কোনো প্রয়োজন থাকে যান। আর যদি আমাকে উপলক্ষ্য করে যান, তাহলে বসুন। মনিং ওয়াকের সময় আমি কিছু। খাই না। দু’একটা কথা বলেই চলে যাব। আল্লাহ রাজি থাকলে আপ্যায়নের দিনতো পালিয়ে যাচ্ছে না।
লতিফ স্যার বসে মৃদু হেসে বললেন, আপনি দেখছি আমার মতো। আমিও এই সময়ে কিছুই খাই না। যাক কি বলবেন বলে এসেছেন বলুন।
হোসেন বলল, স্কুল কমিটি যদি আমাকে পছন্দ করেন, তা হলে দু’একমাস কারো বাড়ির সদরে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলবেন। আব্বা-আম্মা মারা যাওয়ার পর এক আত্মীয় আমাদের ঘরে থাকত। কয়েক বছর হল তারা নেই। তাই শূন্য ভিটেয় ঘর করার জন্য দু’এক মাস থাকতে চাই।
লতিফ স্যার বললেন, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব। তারপর বললেন, স্কুলের সেক্রেটারী শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন লোক। আমার মনে হয়, আমি বললে উনি না করতে পারবেন না।
তাহলে আসি স্যার বলে হোসেন সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে চলে এল। ঘরে ফিরে এলে আসমা বলল, হাত মুখ ধুয়ে এস, আমি নাস্তা নিয়ে আসি। হোসেন বলল, দাইহান ভাই কোথায়? কামলাদের নিয়ে ক্ষেতে গেছে। সে আসুক এক সঙ্গে খাব।
সে পান্তা খেয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তোমাকে নাস্তা দিতে। তার ফিরতে দেরি হবে।
নাস্তা খেতে দিয়ে আসমা বলল, হোসেন ভাই দু’একটা কথা বলব। কিছু মনে করবে না বল।
হোসেন বলল, কিছু মনে করব কেন? কি বলতে চাও বল।
বাহিরবাগের রুকসানার কথা তোমার মনে আছে?
হোসেন মুখে খাবার তুলেছিল, আসমার কথা শুনে চমকে উঠে হাত নামিয়ে নিয়ে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। এত বছর যার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তার কথা তো ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তারপর খেতে শুরু করল।
সে কিন্তু তোমাকে ভুলেনি।
হোসেন আবার চমকে উঠে বলল, এটা তোমার ভুল কথা।
ভুল নয় হোসেন ভাই, চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য।
তাই যদি হয়, সেটা আমার সৌভাগ্য।
তোমার সৌভাগ্য রুকসানার দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে।
তা কেন? সে ধনী কন্যা। নিশ্চয় স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে?
তাই যদি হতো, তা হলে তার কথা তোমার কাছে তুলতাম না। সে তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে মা-বাবা, ভাই-ভাবিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিনের পর দিন নিজেকে ক্ষয় করে চলেছে।