দাইহান ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে যেতে যেতে বলল, প্রথমে তোমাকে চিনতে পারিনি। তুমি যখন চোখ টিপ দিলে তখন চিনতে পারলাম। তারপর বলল, দাদি তোমার কথা প্রায় বলে। মাঝে মাঝে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে, কাজেমের ছেলে থাকতে তার ভিটে শূন্য হয়ে পড়ে আছে।
ইকবাল বলল, ভিটে শূন্য থাকবে কেন? তোমরা তো রয়েছ?
দাইহান বলল, সে অনেক কথা, পরে সব বলব। এখন শুধু এটুকু জেনে রাখ, আমি মুন্সী চাচার মেয়ে আসমাকে বিয়ে করেছি। তারপর জমিও ঘর করে দেওয়ার কথা বলে বলল, তোমাদের ভিটের পাশেই আমরা থাকি। তবে তোমাদের ভিটেতে আমি তরি-তরকারির চাষ করি।
আসমার কথা শুনে ইকবালের রুকসানাকে মনে পড়ল। সেই সাথে মনের মধ্যে একটা আলোড়ন অনুভব করল। ভাবল, ওর কাছে নিশ্চয় রুকসানার খবর জানা যাবে। মনের ভাব গোপন করে বলল, তাই নাকি? তাহলে তো তোমার ভাগ্য খুলে গেছে?
হ্যাঁ তা খুলেছে। আল্লাহর রহমতে আমাদের কোনো অভাব নেই।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ইকবাল বলল, দাইহান ভাই, তোমাকে আমার একটা উপকার করতে হবে। কাজটা তেমন কঠিন না হলেও কঠিন।
তুমি বল ইকবাল, যদি অন্যায় কোনো কিছু না হয়, তবে ইনশাআল্লাহ যত কঠিন কাজ হোক না কেন করে দেব।
পরে তোমাকে সব কিছু বলব, এখন শুধু এতটুকু বলছি, আমি এখানে থাকার জন্য এসেছি। আর আমি যে কাজেম সেখের ছেলে ইকবাল, তা গ্রামের কোনো লোক যেন জানতে না পারে।
দাদি ও আসমার কাছেও কি গোপন রাখতে হবে?
তাদেরকে যা বলার আমি বলব। আর তোমার শ্বশুর মুন্সী চাচা ও তোমার আব্বাকে বলব। নচেৎ বেশি দিন থাকতে দেখলে গ্রামের পাঁচজন পাঁচ কথা বলবে। কেউ কিছু বললে ওঁরাই তাদেরকে যা বলার বলবেন।
ততক্ষণে তারা দাইহানের ঘরে পৌঁছে গেল।
রহিমন ঘরের বারান্দায় নামায পড়ে দাইহানের আট মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে মসল্লার উপর বসে তসবীহ পড়ছিল। আর আসমা উঠোনের একপাশে মুরগী হাঁসকে কুঁড়ো ফ্যানের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াচ্ছিল। সাড়া শব্দ না দিয়ে স্বামীকে একজন দাড়িওয়ালা লোককে নিয়ে আসতে দেখে রেগে গিয়ে বাঁ হাতে ঘোমটা টেনে তাড়াতাড়ি রান্না ঘরের পিছনে চলে গেল।
রহিমন ঐ একই কারণে ঘোমটা টেনে রেগে গেল।
দাইহান হেসে উঠে বলল, তোমরা কাকে দেখে ঘোমটা দিচ্ছ, এত আমাদের। কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল।
দাদি ঘোমটা সরিয়ে দাইহানকে বলল, তাই বল, সাড়া শব্দ না দিয়ে বেগানা লোককে নিয়ে আসতে দেখে আমি তো রেগে গিয়েছিলাম।
ইকবাল দাদিকে সালাম করে বলল, কেমন আছেন?
রহিমন তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ খুব ভালো রেখেছে। ভাই। তুমি কেমন আছ? এতদিন আসনি কেন? তোমার কথা মনে পড়লে চোখে পানি আসে।
আর পানি আসবে না। এখানে থাকব বলে একেবারে চলে এসেছি। তারপর তার কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে বলল, বাহ! খুব সুন্দর মেয়ে তো? তারপর দাইহানের। দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয় তোমার মেয়ে? কি নাম রেখেছ?
দাইহান হাসি মুখে বলল, ও আসমার মেয়ে। নাম যয়নাব বিনতে দাইহান। আর ছেলেটা আমার। তার নাম ইব্রাহীম বিন দাইহান। দু’টো নামই আসমা রেখেছে।
ইকবাল হেসে উঠে বলল, নাম অনুযায়ী ছেলে মেয়ে দুটোই তো তোমার। আসমার বলছ কেন?
তা জানি না। আসমা সব সময় ঐ কথা বলে, তাই বললাম।
তা তোমার ছেলেকে দেখছি না কেন?
আমার সমন্ধীর কোনো সন্তান হয়নি। যয়নাব হওয়ার পর থেকে সে মামা-মামীর কাছেই থাকে।
দাদি দাইহানকে বলল, ইকবালকে বসার জায়গা দিবিতো। তারপর ইকবালকে বলল, যয়নাবকে আমার কোলে দাও ভাই, তোমার কাপড়ে পেশাব করে দেবে।
আসমা ইকবালকে চিনতে পেরে হাত ধুয়ে এসে আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। এবার ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে বারান্দায় রেখে ঘোমটার ভেতর থেকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন ইকবাল ভাই?
ইকবাল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর বলল, দাইহান ভাইয়ের কাছে তোমার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছি।
আপনি বসুন ইকবাল ভাই, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি। কথা শেষ করে ঘরে ঢুকে গেল।
ইকবাল চেয়ারে না বসে দাদির পাশে মসল্লায় বসতে গেলে রহিমন বলল, এখানে বসছ কেন? চেয়ারে বস।
ইকবাল বলল, আপনি মুরুব্বি মানুষ। মুরুব্বিকে নিচে বসিয়ে চেয়ারে বসা আদবের বরখেলাপ। তারপর দাইহানকে বলল, আসার পর থেকে তোমাদের অনেক। কিছু পরিবর্তন দেখছি। তার মধ্যে তোমাকে নামায পড়তে দেখলাম, আসমাকেও পর্দা করতে দেখলাম।
দাইহান বলার আগে দাদি বলল, যা কিছু দেখছ সব আসমার জন্য হয়েছে। আর পর্দার কথা যে বললে, আসমার ভাবি আমাদেরকে তবলীগ করে। শুধু আমাদেরকে নয়, গ্রামের সব মেয়েদেরকে কুরআন হাদিসের কথা বলে পর্দা করতে শিখিয়েছে। আসমাও এখন তার সাথে তবলীগ করে। আসমার ভাবির মা-বাবা একবার এসেছিল। তারাও তবলীগ করে নামায পড়তে ও নামায রোযার অনেক মসলাও শিখিয়েছে। শাকিলের সমন্ধি ঢাকায় বিয়ে করেছে। সেই মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়িকে তবলীগে ভিড়িয়েছে।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলে ইকবাল বলল, খুব ভালো কথা শুনলাম। প্রতিটি গ্রামে যদি এরকম মেয়ে একজনও থাকত, তাহলে কতই না ভালো হত।
নাস্তা খেতে খেতে মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেল। মসজিদে যাওয়ার সময় ইকবাল দাইহানকে বলল, নামায পড়ে ফেরার সময় তোমার সমন্ধি শ্বশুর ও তোমার আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। ওঁদের সামনেই সবকিছু বলতে চাই। কারণ ওঁদেরও সাহায্য আমার দরকার।