সংসারের সব দায়-দায়িত্ব রুকসানার উপর। তার এখনও বিয়ে হয়নি। অবশ্য বি.এ. পাশ করার পর আব্দুল মতিন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রুকসানা রাজি হয়নি। তিন ভাইয়ের বৌয়েরা শিক্ষিতা। ভাইয়েরা ও তাদের বৌয়েরা রুকসানাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। চৌধুরী বাড়ির প্রথম সন্তান হিসাবে রুকসানাকে সবাই বড় আপা বলে। তার কথার এতটুকু অমান্য করার সাহস কারো নেই। তিন ভাই ও তিন জা বড় আপার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
আজিজা বেগম নিজে যেমন ধর্মীয় সবকিছু মেনে চলেন, ছেলে-মেয়েদেরকেও তেমনি ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন। তাই তারা স্কুল কলেজে পড়লেও ধর্মীয় সবকিছু মেনে চলে।
রুকসানা বি.এ. পাশ করার পর সমাজ কল্যাণের কাজ করছে। বোরখা পরে গ্রামের সহায় সম্বলহীন দুস্থ নারী-পুরুষদের খোঁজ নিয়ে যাকে যেভাবে সাহায্য করা দরকার, সেইভাবে তাকে সাহায্য করে। গরিব ঘরের যে সব মেয়েদের টাকার জন্য বিয়ে হয়নি, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। বিধবা ও গরিব ঘরের বৌয়েদের এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিত ছেলেদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটিরশিল্পের একটা কারখানা করেছে। সকাল বিকেল সেটা দেখা-শোনা করে। বাড়ির নিচতলার একটা বড় রুমে নাইট স্কুল খুলেছে। রুমটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। মাঝখানে হার্ডবোর্ডের পার্টিশন করা। একপাশে মেয়েরা বসে আর একপাশে পুরুষরা। তাদেরকে রুকসানা প্রথমে বাংলা ও কুরআন শিক্ষা দেয়। পরে ইসলামের মৌলিক নিয়ম-কানুন ও মসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়। গ্রামের ছোট বড় সবার কাছে রুকসানা বড় আপা নামে সুপরিচিত। যে কেউ যে কোনো সমস্যায় পড়লে বড় আপার কাছে আসে। রুকসানা যথাসাধ্য তাদের সমস্যা সমাধান করে দেয়।
চৌধুরী বাড়িতে সুখ-স্বাচ্ছন্দের কোনো অভাব নেই। কিন্তু রুকসানা বিয়ে করতে রাজি না হয়ে ক্রমশ সমাজ কল্যাণের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে দেখে তার মা-বাবা, ভাই ও তাদের বৌয়েরা অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। আজ যোহরের নামাযের পর তিন জা পরামর্শ করল, বড় আপা কেন বিয়ে করতে চায় না জানতে হবে।
বড় জা সুরাইয়া বলল, আমার মনে হয় বড় আপা কলেজে পড়ার সময় কাউকে ভালবেসেছিল, সে হয়তো বিট্টে করেছে।
মেজ আরেফা বলল, আমারও তাই মনে হয়।
ছোট মমতাজ বলল, তা হয়তো হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, বড় আপা। স্কুলে পড়ার সময় গ্রামের কোনো গরিব ছেলেকে ভালবেসেছিল, সাহস করে আব্বা আম্মাকে জানাতে পারেনি। তাই বিয়ে করেনি।
সুরাইয়া বলল, তোমার কথা শুনে এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। কারণ আমি তাকে প্রায়ই দিন আসরের নামাযের পর বাগানে যেতে দেখে একদিন করিমন বুয়াকে পাঠিয়েছিলাম। সে ফিরে এসে বলল, বড় আপা বাগানের দক্ষিণ দিকে যে দালান আছে, সেখানে বসে আছে, আর তার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
সুরাইয়া থেমে যেতে আরেফা বলল, তোমার আগে আমিও একদিন চর লাগিয়ে সেকথা জেনেছি। তাই তো ঐ কথা বললাম।
মমতাজ বড় জাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমাদের দুজনের চেয়ে বড় আপার সঙ্গে তোমার বেশি ভাব। তুমিই এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলাপ কর।
আরেফা বলল, আমিও কথাটা বলব ভাবছিলাম।
সুরাইয়া বলল, ঠিক আছে, সময় সুযোগ পেলে দু’একদিনের মধ্যে আলাপ করব।
আজ যখন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল তখন মাগরিবের নামাযের পর চা-নাস্তা খাওয়ার। জন্য একে একে সবাই ডাইনিংরুমে এসে মেঝেয় বিছানো কার্পেটের উপর দস্তরখানের চারপাশে বসল। তিন জা চায়ের ফ্লাক্স ও নাস্তার প্লেট নিয়ে এল। কিন্তু পরিবেশন করল না। আব্দুল মতিন শুধু হুইল চেয়ারে বসে আছেন। তাই তার সামনে একটা ছোট টেবিল। আগে চেয়ার-টেবিলে খাওয়া হত। সুন্নাতের বরখেলাপ বলে রুকসানাই মেঝেয় বসে খাওয়ার নিয়ম চালু করেছে। তার জন্যেই সবাই অপেক্ষা করছে।
রুকসানা প্রত্যেক নামাযের পর কিছুক্ষণ অজিফা পড়ে। তাই তার আসতে দেরি হয়। অজিফা শেষ করে এসে মনিরার পাশে বসল।
তিন জা নাস্তা পরিবেশন করে নিজেরাও বসল।
রুকসানা বলল, তোমাদেরকে কত দিন বলেছি, আমার জন্যে অপেক্ষা না করে খেতে শুরু করবে। তবু যে কেন তোমরা আমার জন্য বসে থাক বুঝতে পারি না।
কেউ কিছু বলার আগে ছোট ভাই আব্দুল করিম বলল, বড় আপা, তোমাকে ছাড়া আমরা আগে খাব, একথা ভাবলে কী করে? আব্বা আম্মা ছাড়া এ বাড়ির ঘাড়ে কারো রক্ত আছে তোমার আগে খাবে?
রুকসানা বলল, এ কথা বলছিস কেন রে? আগে খেলে আমি তোদের ঘাড় মটকে দেব নাকি?
মনিরা একটু ঠোঁটকাটা। তা ছাড়া সবার ছোট বলে সকলে তাকে আদর করে। বলল, বড় আপা অজিফাটা একটু কম করলেই হয়।
মেজ ভাই আব্দুস সামাদ মনিরার অন্য পাশে বসেছে। তাকে ধমকের সুরে বলল, বেয়াদবের মতো কথা বলবি না। দেব এক থাপ্পড়।
মনিরা বলল, বড় আপার সামনে কই মারতো দেখি?
রুকসানা বলল, তোমরা সব থামতো। খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে নেই। আমি না হয় এবার থেকে একটু আগেই আসব।
এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না।
চা খাওয়ার সময় রুকসানা মনিরাকে বলল, কিরে, পড়াশোনা ঠিকমতো করছিস তো?
মনিরা গাল ফুলিয়ে বলল, তোমাদেরকে কবে থেকে বলছি একজন অঙ্কের টিচারের ব্যবস্থা কর। তোমরা আমার কথা কানেই তোলো না। দেখে নিও এবারে নির্ঘাৎ ফেল করব। তারপর চায়ের খালি কাপটা শব্দ করে রেখে চলে গেল।