ইকবাল ঢাকায় পৌঁছে খালেক চাচার বাড়িতে উঠল।
খালেক, ফরিদা ও রেফাত খুব সমাদর করল। পরিচয় হওয়ার পর রেফাতের স্ত্রীও তাকে সম্মানের সাথে খাতির যত্ন করল।
মালেকাকে দেখতে না পেয়ে এক সময় ইকবাল রেফাতের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, মালেকা কি কোথাও গেছে? তাকে দেখছি না যে?
রেফাতের স্ত্রী বলল, মালেকা বছর দুয়েক হল ফরিদপুর মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করছে। সেখানেই মেয়েদের হোস্টেলে থাকে। কলেজ বন্ধ থাকলে মাঝে মাঝে আসে। আপনার চিঠি এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করে। আপনার চিঠি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে।
আপনারা তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন নি?
এমন সময় খালেক সেখানে এসে কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, তা আর করিনি বাবা, কিন্তু সে রাজি হয়নি। তারপর বলল, মালেকা যে ফরিদপুর মহিলা কলেজে। অধ্যাপনা করছে, তা নিশ্চয় বৌমার কাছে শুনেছ?
ইকবাল বলল, জ্বি। মালেকা কেন বিয়ে করতে চায় না তা বুঝতে পেরে ইকবাল নিজের কাছে খুব ছোট হয়ে গেল। বলল, ঠিকানাটা দিন, কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যাব, আমি সময় করে তার সাথে দেখা করব।
খালেক বলল, হ্যাঁ বাবা তাই করো। তাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো, পুরুষই হোক আর মেয়েই হোক, বিয়ে না করলে জীবনে সুখ-শান্তি পাওয়া যায় না। তুমি। বোঝালে নিশ্চয় শুনবে।
ইকবাল বলল, ঠিক আছে চাচা, যা বলার আমি বলব, আপনারা আর চিন্তা করবেন না।
দিন দুয়েক পর খালেক স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ইকবালকে বলল, আমরা ছাড়া তোমার কোনো গার্জেন নেই। তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। হাদিসে আছে, সামর্থবান অবস্থায় বিয়ের বয়স হলে বিয়ে করা সুন্নত। তুমিও বোধহয়, হাদিসটা জান। তাই আমরা তোমার বিয়ে দিতে চাই। তুমি ঘুরে এস, এদিকে আমরা মেয়ে দেখি।
ইকবাল বলল, আমিও ভেবেছি এবার বিয়ে করব। আর আমি গ্রামের বাড়িতে থাকতে চাই, তাই গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করার আমার ইচ্ছা। মেয়ে পছন্দ হওয়ার পর আপনাদের খবর দেব। আপনারা ছাড়া আমার যখন কেউ নেই তখন আপনারা গিয়ে বিয়ের কাজ সমাধা করবেন। ফরিদপুর থেকে মালেকাকেও নিয়ে আসব।
খালেক বলল, তুমি যা ভালো বুঝবে করবে। তাতে আমরাও খুশি।
পাঁচদিন থেকে ইকবাল গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা দিল। যখন বাড়িতে এসে পৌঁছাল তখন বিকেল পাঁচটা।
গেঁদু মুন্সীর মেয়ে আসমাকে বিয়ে করে দাইহানের অবস্থা ফিরে গেছে। গেঁদু মুন্সী বিয়ের সময় মেয়েকে পাঁচ বিঘে জমি দিয়েছেন। কাজেমের ভিটের পাশে নিজের জায়গায় দু’কামরা ঘর করে দিয়েছেন। হালের গরুও দিয়েছেন। তাছাড়া সমন্ধী শাকিল বোনকে সুখি করার জন্য সবদিক থেকে দাইহানকে সাহায্য করে। দাইহান খুব কর্মঠ ছেলে। শ্বশুর ও সমন্ধির সাহায্য সহযোগিতায় অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছে। শ্বশুরের কথা মতো কাজেম সেখের ভিটেয় তরি-তরকারি চাষ করে।
ইকবাল গ্রামে পৌঁছে আসরের আজান শুনে মসজিদে গেল। ব্রীফকেস ও চামড়ার ব্যাগটা বারান্দায় রেখে অযু করে মসজিদে ঢুকে দেখল, মসজিদের অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। তার মনে হল, পনের বছর আগে যখন একবার এসেছিল তখন এতটা জরাজীর্ণ ছিল না। মোটামুটি নামায পড়ার যোগ্য ছিল। কিন্তু এখন পাকা মেঝে চটা উঠে খাবলা খাবলা হয়ে গেছে। বেড়াগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। টিনের চালটা মর্চে পড়ে অনেক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। দরজা ও জানালার একটারও পাল্লা নেই। ছেঁড়া খেজুর চাটাই বিছিয়ে পাঁচ-ছজন ছেলে বুড়ো মুসুল্লীকে জামাত করে নামায পড়তে দেখে সেও তাদের সঙ্গে জামাতে সামিল হল।
মুসুল্লীদের মধ্যে কাজেমের চাচাতো ভাই ফজল ছিল। তার ছেলে দাইহান ও গেঁদু মুন্সীও ছিল। নামাযের পর দাড়ি রাখা ইকবালকে তারা চিনতে পারল না। গেঁদু মুন্সী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোন গ্রামের মানুষ?
ইকবাল বলল, আমি ঢাকা থেকে গ্রাম দেখতে এসেছি। আপনারা কেউ যদি আমাকে কয়েক দিন থাকার জায়গা দেন, তাহলে খুব উপকার হত।
পনের ষোল বছর আগে দাইহান চার পাঁচ দিন ইকবালের সঙ্গে থেকেছে। তাই ইকবালের মুখে দাড়ি থাকা সত্ত্বেও চেনা চেনা মনে হল। বলল, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
ইকবাল দু’জনকে ছাড়া সবাইকে চিনতে পেরেছে। দাইহান থেমে যেতে তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলল, আপনাকেও আমার চেনা চেনা লাগছে। যদি দয়া করে কয়েক দিন আপনাদের বাড়িতে রাখেন, তাহলে আমার ইচ্ছাটা পূরণ হত। অবশ্য যে কয়েকদিন থাকব, খরচাপাতি দিয়েই থাকব।
ইকবাল চোখ টিপ দিতে ও তার কথা শুনে দাইহান চিনতে পারল। সেই সাথে বুঝতে পারল, ইকবাল পরিচয় গোপন করতে চায়। তাই সেও ইকবালকে চোখ টিপে জানিয়ে দিল তাকে চিনতে পেরেছে। তারপর কৃপণ শ্বশুরকে খুশি করার জন্য তার দিকে তাকিয়ে বলল, উনি যখন খরচপাতি দিয়ে থাকতে চাচ্ছেন তখন আমাদের বাড়িতে না হয় ক’টা দিন থাকুক আপনি কি বলেন আব্বা?
খরচপাতি দিয়ে থাকবে শুনে গেঁদু মুন্সী না করতে পারলেন না। তবু জামাইকে একটু দুরে নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, রাখতে চাও রাখ। কিন্তু খুব, সাবধানে থেক। অনেকে ডাকাতি করার জন্য এরকম ভালো মানুষ সেজে আসে।
দাইহানের হাসি পেল। চেপে রেখে বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে ওনাকে দেখে সে রকম মনে হচ্ছে না। তবু খুব সাবধানে থাকব। তারপর শ্বশুরকে নিয়ে ফিরে এসে ইকবালকে বলল, চলুন আমার কাছে থাকবেন।