কাঁঠাল গাছের কাছাকাছি এসে রুকসানার সাথের একটা মেয়ে বলে উঠল, কিরে রুকসানা, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেন? কেউ আসার কথা ছিল নাকি?
আসমার মুখে ইকবালের কথা শোনার পর থেকে রুকসানার মন খারাপ হয়েছিল। মেয়েটার কথা শুনে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, দেখ সালেহা, ফাজলামী করবি না।
তারপর তাদের আর কোনো কথা ইকবাল শুনতে পেল না। কারণ তারা কিছুটা দূরে চলে গেছে। রুকসানাকে যতক্ষণ দেখা গেল তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে ফিরে আসতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, রুকসানা বেশ বড় হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যও খুব সুন্দর হয়েছে। আল্লাহকে জানাল, “আল্লাহ গো তুমি, আমার বাসনা পূরণ করো।”
.
বিকেলে রহিমন গেঁদু মুন্সীর কাছে গিয়ে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন?
গেঁদু মুন্সী বললেন, শুনলাম, কাজেমের ছেলে নাকি ম্যাট্রিক পাশ করে ফিরে এসেছে।
রহিমন বলল, দাইহান তাই তো বলল।
কেন এসেছে?
মা-বাপের কাছে ছেলে আসবে না তো কার কাছে আসবে?
মা-বাপ মরে গেছে শুনে কি বলল?
কি আবার বলবে, কান্নাকাটি করল। মা বাপের নামে মসজিদ মাদ্রাসায় এক হাজার টাকা দান করেছে।
তা শুনেছি। এখানেই থাকবে নাকি?
আমি থাকতে বলেছিলাম। বলল, “আরো পড়াশোনা করবে। তাই দু’চার দিন পরে ঢাকা চলে যাবে। আল্লাহ যদি কোনোদিন আবার আনায় তখন থাকবে।”
কাজেম যখন ছেলের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল তখন গেঁদু মুন্সী তাদের ভিটেটা নেওয়ার জন্য তাকে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কাজেম পাগল অবস্থায় হঠাৎ একদিন মারা যাওয়ায় রেজেস্ট্রি করার সুযোগ পাইনি। তারপর একদিন তার স্ত্রীকে বলেন, কাজেম ভিটেটা আমার নামে লিখে দেওয়ার কথা বলে যে টাকা নিয়েছিল, তা তুমিও জান। আর টাকাটা তুমি নিজের হাতে নিয়েছ। এখন তুমি তার সম্পত্তির মালিক। আরো কিছু টাকা দিচ্ছি, ভিটাটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দাও। তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করব।
নাজমা বলল, আমার স্বামী পাগল হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে কি বলেছে না বলেছে আমি জানি না। তবে টাকা আমার হাতে দিয়েছেন এটা ঠিক। তখন আমি মনে করেছিলাম আপনি দয়া করে আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য দিচ্ছেন। তার ভিটে বেঁচলে আমি থাকব কোথায়?
গেঁদু মুন্সী বললেন, তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এখানেই থাকবে। তারপর আমি দখল নেব।
আপনি তো জানেন, আমার একটা মাত্র ছেলে ইকবাল দু’বছর হল কোথা চলে গেছে। সে যদি ফিরে আসে?
যখন ফিরে আসবে তখন যা করার করা যাবে।
না-না ভিটে আমি বেঁচব না। আপনি চলে যান। তারপর নাজমা ফুঁপিয়ে উঠে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফোপাতে লাগল।
গেঁদু মুন্সী বললেন, ঠিক আছে এখন আমি যাচ্ছি। ভেবে চিন্তে পরে না হয় আমার কাছে যেও। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
নাজমা এক সময় চাচাতো দেবর ফজলের কাছে গেঁদু মুন্সীর কথাটা জানাল।
ফজল বলল, গেঁদু মুন্সী কাজেম ভাইকে কত টাকা দিয়েছিল মনে আছে?
নাজমা বলল, এমনি দয়া করে দিচ্ছে ভেবে হিসেব রাখিনি। তবে যতটা মনে পড়ে শ পাঁচেক হবে।
ফজল বলল, মুন্সী ব্যাটা খুব ঘুঘু। মনে করেছিল, পাগলকে সামান্য কিছু দিয়ে ভিটেটা লিখে নিবে। যা বলছি শোন ভাবি, ইকবালকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। তুমি কারো কোনো কাগজে টিপ সই দিও না। কেউ যদি ভয় টয় দেখায়, আমাকে জানাবে।
তারপর নাজমার অসুখের সময় গেঁদু মুন্সী টাকা সেধে টিপ সই নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু নাজমা টাকাও নেয়নি আর টিপ সইও দেয়নি। চাচাতো দেবর ফজল গরিব। তবু যতটুকু পেরেছে চাচাতো ভাবিকে সাহায্য করেছে। নাজমা মারা যাওয়ার পর ফজলই প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছেলে দাইহানকে ও তার মা রহিমনকে কাজেমের ভিটেয় থাকার কথা বলে।
সে কথা জেনে গেঁদু মুন্সী ফজলকে ধমক দিয়ে বললেন, কাজেম ভিটে বিক্রি করার কথা বলে আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিল। পাগল হয়ে যাওয়ার কারণে রেজেস্ট্রি করে দেয়নি। তোমরা দখল নিয়েছ কেন? ঐ ভিটে তো আমার।
ফজল বলল, কাজেমকে যে টাকা দিয়েছিলেন তার কোনো সাক্ষী আছে? যদি থাকে মামলা করে ডিগ্রি নিয়ে আসুন।
গেঁদু মুন্সী রেগে উঠে বললেন, ঠিক আছে ডিগ্রি নিয়েই আসব। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল।
কথাটা রাগের মাথায় বললেও গেঁদু মুন্সী টাকা খরচ হওয়ার ভয়ে মামলা করেন নি। এতদিন পরে কাজেমের ছেলে ইকবাল এসে মসজিদ মাদ্রাসায় বাপ মার নামে দান করছে শুনে মনে করেছেন, ইকবাল তা হলে অনেক টাকা এনেছে। তাই চিন্তা করলেন প্রথমে ইকবালকে দিয়ে ওদেরকে ভিটে থেকে তাড়াবে, তারপর তার বাপকে যে টাকা দিয়েছে তার তিন গুণ টাকার কথা বলে শোধ করতে বলবেন, আর টাকা দিতে না পারলে ভিটেটা লিখে দিতে বলবেন। তাই আজ রহিমনকে ডেকে পাঠিয়েছেন ইকবালের খবর জানার জন্য। এখন রহিমনের কাছে ইকবাল ঢাকায় পড়তে চলে যাবে শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইকবালকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।
রহিমন বলল, তা বলব। এবার যাই তাহলে?
গেঁদু মুন্সী বললেন, ঠিক আছে যাও।
রাত্রে খাওয়ার সময় ইকবাল বলল, আমি সকালে চলে যাব।
দাইহান বলল, আর কটা দিন থাক না।
ইকবাল বলল, থাকতে পারব না, কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে।
রহিমন ইকবালের দিকে চেয়ে বলল, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। গেঁদু মুন্সী তোমাকে দেখা করতে বলেছে। দু’একদিন পরে গেলে হয় না?