গেঁদু মুন্সী রেগে উঠে বললো, আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। ঐ সব ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দিতে পারি কিনা দেখিয়ে দেব। তারপর গজগজ করতে করতে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন।
দাইহানকে ফজিলা বেগমের খুব পছন্দ, কিন্তু তাই বলে কামলার ছেলে কামলাকে তো আর জামাই করতে পারেন না। মেয়েকে একদিন সন্ধ্যের পর বৈঠকখানার পিছনে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে ও তাদের কথা বার্তা আড়াল থেকে শুনে বুঝতে পেরেছিলেন। দুজনের সম্পর্কের কথা। তাই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বামীকে বলেছিলেন স্বামীর কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করলেন, আল্লাহ না করুক, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই মেয়েকে একদিন দাইহানের কাছে যেতে নিষেধ করে চোখে চোখে রাখেন। কিন্তু আসমা অশিক্ষিত মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দাইহানের সঙ্গে দেখা করে।
ইকবাল দু’দিন দাইহানের সঙ্গে গ্রাম দেখে বেড়াল। তার পরের দিন খুব সকালে দাইহান বাসি ভাত খেয়ে কাজে গেল। একটু বেলাতে রহিমন ইকবালকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। এমন সময় আসমা এসে রহিমনকে বলল, দাদি, আব্বা আপনাকে দেখা করতে বলেছে।
রহিমন বলল, বলিস বিকেলে যাব।
কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল এসেছে শুনে আসমা কাল সকালে এসেছিল। কিন্তু ইকবাল ঘরে ছিল না। তাই দেখা হয়নি। রহিমন দাদির কাছে তার সব কিছু শুনে স্কুলে গিয়ে রুকসানাকে বলল, জানিস, কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল এস.এস.সি পাশ করে মা-বাবাকে দেখার জন্য কাল এসেছে। রহিমন দাদি বলল, মা-বাবা মারা গেছে শুনে নাকি খুব কেঁদেছে। দু’চার দিন থেকে চলে যাবে।
রুকসানা চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছিস? হারে সত্যি।
আমি তাকে দেখব বলে আজ সকালে গিয়েছিলাম, তখন ঘরে ছিল না, তাই দেখা হয়নি।
ইকবাল এস.এস.সি পাশ করে এসেছে শোনার পর থেকে রুকসানার সমস্ত শরীরে এক ধরনের অজানা আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই তার সঙ্গে দেখা করে বলবি, কাল স্কুল ছুটির সময় এসে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
আসমা বলল, ঠিক আছে বলব।
তাই আজ রহিমন দাদিকে আব্বার কথা বলতে এসে অচেনা একটা ছেলেকে দেখে ভাবল, এ নিশ্চয় ইকবাল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল; কিভাবে রুকসানার কথাটা তাকে বলবে।
আসমাকে ইকবালের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহিমন বলল, তোর কাজেম চাচার ছেলে। এর কথাই কাল তোকে বলেছি। তারপর ইকবালকে বলল, এ হল গেঁদু মুন্সীর মেয়ে আসমা।
ইকবাল একবার আসমার দিকে চেয়ে নিয়ে খেতে লাগল।
রহিমন আসমাকে বলল, তুই একটু বস, আমি পুকুরঘাট থেকে আসছি।
রহিমন চলে যাওয়ার পর আসমা ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে বাহিরবাগ গ্রামের চৌধুরীদের রুকসানা কাল স্কুল ছুটির সময় দেখা করতে বলেছে।
ইকবাল চমকে উঠে খাওয়া বন্ধ করে তার দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, বাহিরবাগ গ্রাম তো অনেক দূর, আমি এসেছি রুকসানা জানল কেমন করে? আর তোমাকে বললই বা কেমন করে?
ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমরা একই ক্লাসে পড়ি। রুকসানা আমার সই। কাল আমিই তাকে বলেছি।
ইকবাল বুঝতে পারল, রুকসানা হয়তো আমাদের সবকিছু আসমাকে বলেছে। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বলল, রুকসানাকে বলল, “আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে। তার সঙ্গে দেখা করা আমার উচিত হবে না।” তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে। গেল।
আসমা তার পিছন দিকে তাকিয়ে ভাবল, রুকসানার কারণে মার খেয়েছিল বলে হয়তো তার উপর এখনো রেগে আছে। তাই ঐ কথা বলল।
একটু পরে রহিমন ফিরে এলে আসমা ঘরে চলে গেল।
ইকবাল আসমাকে ঐ কথা বললেও গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, রুকসানা দেখা করতে বলল, কেন? এটা তার কৌতূহল, না অন্য কিছু? বিড়বিড় করে বলল, তুমি না ডাকলেও আজ যেতাম।
আজ আসমা স্কুলে আসার পর রুকসানা জিজ্ঞেস করল, কিরে, ইকবালের সাথে দেখা হয়েছিল?
আসমা বলল, হ্যাঁ।
আমার কথা বলেছিস?
বলেছি। শুনে বলল, “আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে, তার সঙ্গে দেখা করা আমার উচিত হবে না।”
কথাটা শুনে রুকসানার মুখটা মলিন হয়ে গেল। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
আসমা তার মুখের অবস্থা দেখে বলল, তুই মন খারাপ করছিস কেন? সে তো আর জানে না, সেদিনের ঘটনার জন্য তুই দায়ী না। আমার মনে হয় তোকে দায়ী ভেবে তোর প্রতি আজও রেগে আছে।
তবু যখন রুকসানা কিছু বলল না তখন বলল, কিরে কী ভাবছিস?
কি আর ভাববো? বাদ দে তার কথা, তোর দাইহানের কথা বল।
তার কথা নতুন করে আর কি বলব? জানি না আল্লাহ আমার তকদিরে কি রেখেছে।
এমন সময় স্যারকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে রুকসানা কুনয়ের গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই চুপ কর, স্যার এসে গেছেন।
.
দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ইকবাল স্কুলের পথে রওয়ানা দিল। যখন স্কুলের কাছে পৌঁছাল তখনও ছুটি হতে আধঘণ্টা দেরি। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক বেরিয়ে বাহিরবাগ যাওয়ার রাস্তার মোড়ে একটা মোটা কাঁঠাল গাছের তলায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর ছুটির ঘণ্টা পড়তে শুনে দাঁড়িয়ে স্কুলের গেটের দিকে তাকিয়ে রইল। গেট খুলে যাওয়ার পর প্রথমে নিচের ক্লাসের মেয়েরা হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল। তারপর বড় বড় মেয়েদের বেরোতে দেখে সতর্ক দৃষ্টিতে রুকসানাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ কয়েকজন মেয়ের মধ্যে দু’টো বোরখা পরা মেয়েকে বেরোতে দেখে তাদের দিকে লক্ষ রাখল। বোরখা পরা থাকলেও দুজনেরই মুখে নেকাব নেই। তাদের একজনকে চিনতে পারল, আসমা। পাশের মেয়েটার চোখে বিশেষ ধরনের সানগ্লাস দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় রুকসানা। কথা বলতে বলতে দু’জনে রাস্তার মোড়ের দিকে কিছুটা এসে আসমাকে নিজের গ্রামের পথে চলে যেতে দেখল। আর রুকসানাকে কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের রাস্তার দিকে এগিয়ে আসার সময় এদিক ওদিক তাকাতে দেখে ইকবাল নিজেকে গাছের আড়ালে রেখে দেখতে লাগল।