রহিমন আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে বলল, এতদিন কোথায় ছিলিরে ভাই? দু’তিন বছর আগে এলে মা-বাপকে দেখতে পেতিস।
ইকবাল কিছু বলার আগে দাইহান বলল, জান দাদি, ওনা ঢাকায় একজনের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছে।
আহারে কাজেম ও তার বৌ বেঁচে থাকলে কত্তো খুশি হত। তারপর ঘরে বসিয়ে মুড়ি খেতে দিয়ে বলল, আমরা ভাই গরিব মানুষ, এগুলো খেতে খেতে দাইহানের সাথে গল্প কর। ও তোমার বড় ভাই লাগে, আর আমি তোমার দাদি। যাই রান্না করি বলে রহিমন বেরিয়ে এসে শাক কুটতে লাগল।
কাজেমের ছেলে ইকবাল এসেছে শুনে গ্রামের ছোট বড় সব ধরনের মেয়ে পুরুষ তাকে দেখে যেতে লাগল।
ইকবাল আব্বার হাতে মার খেয়ে যে প্রতিজ্ঞা করে ঢাকা চলে গিয়েছিল, সে কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলেনি। তাই আল্লাহর দেওয়া মেধাকে কাজে লাগিয়ে এত ভালো রেজাল্ট করেছে। গ্রামের বাড়িতে এসে মা-বাবার পরিণতির কথা শুনে যত দুঃখ পেয়েছে সেই প্রতিজ্ঞার প্রতি ততো কঠোর হয়েছে। তাই রুকসানার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কয়েকদিন থাকার মনস্থ করল। তারপর হিসাব করে দেখল, রুকসানা। এ বছর টেনে উঠেছে।
ইকবাল যে পাঁচ হাজার টাকা এনেছিল, তা থেকে আব্বা আম্মার রুহের মাগ ফেরাতের জন্য পাঁচশ টাকা মসজিদে ও পাঁচশ মাদ্রাসায় দান করল। আর দাইহানের সামনে দাদিকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, আমি ছাত্র পড়িয়ে কিছু টাকা রোজগার করে এনেছিলাম আব্বা আম্মাকে দেওয়ার জন্য। তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা আব্বা আম্মার নামে মসজিদে ও মাদ্রাসায় দিয়েছি, এটা আপনারা রাখুন। আমি চার পাঁচদিন পর চলে যাব।
রহিমন ইকবালের মাথায় চুমো খেয়ে ভিজে গলায় দোয়া করল, আল্লাহ তোকে সহি সালামতে রাখুক। আমার মাথায় যত চুল, তত হায়াৎ দিক। তারপর দাইহানকে টাকাগুলো দিয়ে বলল, তুলে রাখ।
গেঁদু মুন্সীর অবস্থা খুব ভালো। গ্রামে প্রতিপত্তিও আছে। কিন্তু ভীষণ কৃপণ। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম শাকিল। মোটা বুদ্ধির কারণে ফেল করে করে ফাঁইভ পর্যন্ত পড়ে আর পড়েনি। বাপের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করে। দাইহানের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব। দাইহান বছরের বেশির ভাগ সময় তাদের ক্ষেত খামারের কাজ করে। মেয়ে আসমা দেখতে তেমন ভালো না, গায়ের রং কালো, নাক ও ঠোঁট মোটা। স্থূল দেহ। চোখ দুটো ছোট। কিন্তু খুব গুণবতী। যেমন লেখাপড়াতে ভালো তেমনি সংসারের কাজে খুব পটু। নামায রোয়া ঠিকমতো করে। প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করে ও ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়াশোনা করে।
মেয়ে দেখতে ভালো না, বিয়েতে অনেক যৌতুক দিতে হবে। তাই গেঁদু মুন্সী কৃপণ হওয়া সত্ত্বেও মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন এই ভেবে যে, যদি শিক্ষিত করাতে পারে, তাহলে যৌতুক ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন।
অবশ্য আসমার বাড়ন্ত চেহারা দেখে এইটে পড়ার সময় থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নাইনে ওঠার পর বোরখা কিনে দিয়েছেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে মোটা টাকা দাবি করে। তাই আজ বিয়ে দিতে পারেন নি।
আসমা দাইহানকে কিশোর বয়স থেকে ভালবাসে। বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখল, দাইহান গরিবের ছেলে লেখাপড়াও বেশি করেনি, সংসারে সত্য তখন চিন্তা করল, আব্বা জানতে পারলে যা রাগী মানুষ মেয়ে বলে ছেড়ে দেবে না। কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে। এইসব চিন্তা করে ও দাইহানকে ভুলতে পারেনি। সুযোগ পেলেই তার সঙ্গে কথা বলে। দাইহানও আসমাকে ভালবাসে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনোদিন সেকথা তাকে জানতে দেয়নি। যেদিন আসমা তাকে মনের কথা জানায়, সেদিন ভয়। পেয়ে বলেছিল, একথা ভুলেও আর মুখে এনো না। তোমার আব্বা জানতে পারলে আমাকে তো জানে শেষ করে ফেলবেই, তোমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না। তারপর থেকে দাইহান খুব সজাগ থাকে, আসমা যেন একাকী তার সঙ্গে দেখা করতে না পারে। তবু আসমা সতর্কতার সাথে দাইহানের সঙ্গে দেখা করে। দাইহান নিষেধ করলে বলে, তুমি পুরুষ হয়ে এত ভয় পাও কেন? একটা কথা মনে রেখ, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তাতে যদি আব্বার হাতে মরতে হয় তাতেও রাজি। এই কথায় দাইহান আরো ভয় পেয়ে অনেক কিছু বলে বোঝাবার চেষ্টা করে। তখন আসমা আরো রেগে গিয়ে বলে, আমাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হবে না। তবে যেদিন। শুনব তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছ, সেদিন বৌ দেখতে গিয়ে তোমাদের দু’জনের সামনে বিষ খাব।
এইকথা শোনার পর থেকে দাইহান আসমাকে এড়িয়ে চলে। যখন সে গোপনে দেখা করে তখন কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
কিছুদিন আগে বোধহয় তার মা ফজিলা বেগম টের পেয়ে স্বামীকে দাইহানের কথা না বলে শুধু বলেছিলেন, মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করিয়ে কি হবে? তাছাড়া দিন দিন যে ভাবে গা-গতরে বেড়ে যাচ্ছে, বেশি দিন ঘরে রাখা ঠিক হবে না। দিনকালও ভালো না। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।
গেঁদু মুন্সী বললেন, সে কথা আমিও চিন্তা করেছি। কিন্তু ভালো ছেলে পাওয়া। যাচ্ছে না।
ফজিলা বেগম কৃপণ স্বামীর স্বভাবের কথা ভালো ভাবেই জানেন। বললেন, তুমি সোনা-দানা টাকা-পয়সা ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিতে চাও। আজকাল ঐ সব না দিলে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে? তাছাড়া মেয়ে দেখতেও তেমন সুন্দরী না।