সেইদিন থেকে ইকবাল খালেকের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। সেই সাথে রেফাত ও মালেকার সাথে প্রতিদিন সকালে ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় কুরআন পড়া শিখতে লাগল। খালেক ও ফরিদা তাকে ছেলের মতো দেখে। আর ইকবালও তাদেরকে চাচা চাচির মতো দেখে। রেফাত ও মালেকাকে নিজের ভাইবোনের মতো দেখে। ক্রমশ সে বাড়ির ছেলের মতো হয়ে গেল। সেভেন থেকে ফার্স্ট হয়ে এইটে উঠার পর মাস্টারদের নজরে পড়ে গেল। পরের বছর এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে টেলেন্টপুল বৃত্তি পাওয়ার পর সবার কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল। ইকবালকে রাখার ফলে মালেকের ছেলে মেয়ে রেফাত ও মালেকা ভালো রেজাল্ট করতে লাগল। নাইনে উঠার পর ইকবাল বিকেলে খেলাধুলা না করে ক্লাস সিক্সের দুটো ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা পেত তা খরচ না করে জমাতে লাগল। ব্যাপারটা খালেকরা কেউ জানতে পারল না। তারপর এস. এস. সিতে পাঁচটা বিষয়ে স্টার মার্ক নিয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে। পাশ করল।
খালেক ও ফরিদা এতদিন তার সমস্ত পড়ার খরচ জুগিয়েছে। খালেক স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছে ইকবালকে উচ্চ শিক্ষা দিয়ে জামাই করবে। তাই এস. এস. সি পাশ করার পর বলল, তুমি কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা কর, টাকা পয়সার চিন্তা করো না, আমরা দেব।
ইকবাল বলল, কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে আমি আব্বা আম্মার সঙ্গে দেখা। করার জন্য দেশে যাব।
খালেক বলল, এটা তো খুব ভালো কথা। যাতায়াতের খরচ আমার কাছ থেকে নিও।
.
প্রায় আড়াই বছর প্রাইভেট পড়িয়ে ইকবাল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকা নিয়ে একদিন দেশের বাড়ি রওয়ানা হল। গোপালগঞ্জে বাস থেকে নেমে চৌধুরীদের বাগান বাড়িতে গিয়ে নতুন দারোয়ানের কাছে জানতে পারল, প্রায় চার পাঁচ বছর আগে তার আব্বা চাকরি ছেড়ে দিয়ে আম্মাকে নিয়ে নিজেদের গ্রামে দক্ষিণ ফুকরায় চলে গেছে। ইকবাল চৌধুরী বাড়ির সবার অলক্ষে যেমনভাবে বাগান বাড়িতে গিয়েছিল, তেমনিভাবে সবার অলক্ষে সেখান থেকে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে এসে একজন লোককে জিজ্ঞেস করল কাজেম শেখের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?
লোকটার নাম গেঁদু মুন্সী। বললেন, কাজেম ছেলের শোকে পাগল হয়ে দু’বছর আগে মারা গেছে। তার বৌও বছর খানেক হল মারা গেছে। তার ঘরে কাজেমের এক বুড়ি চাচি তার নাতিকে নিয়ে থাকে। এমন সময় একটা যুবককে খালি গায়ে গামছা কাঁধে আসতে দেখে বললেন, ঐ তো বুড়ির নাতি দাইহান আসছে। কাছে এলে গেঁদু মুন্সী ইকবালকে দেখিয়ে তাকে বললেন, এই ছেলেটা তোমার কাজেম চাচার খোঁজ করছে। তারপর কাজ আছে চলি বলে চলে গেলেন।
দাইহানের বাবা ফজল কাজেমের চাচাতো ভাই। দাইহানকে ছোট রেখে তার মা মারা গেছে। ফজল আবার বিয়ে করেছে। সেই স্ত্রীর গর্ভে পাঁচ ছটা ছেলে মেয়ে হয়েছে। দাইহানকে সত্য একদম দেখতে পারে না। ফজলের মা রহিমন নাতিকে মানুষ করে। যখন কাজেম ও তার স্ত্রী মারা যায় তখন দাইহান পূর্ণ যুবক। সৎ মায়ের সঙ্গে তার প্রায় ঝগড়া হত। তাই কাজেম ও তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তাদের ঘরে দাদিকে নিয়ে থাকে।
গেঁদু মুন্সী যাওয়ার পর দাইহান ইকবালের দিকে তাকিয়ে তার জামা কাপড় দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে তুমি? কোথা থেকে আসছ?
আমি ইকবাল ঢাকা থেকে আসছি।
কাজেম চাচা যে তার ছেলে ইকবালকে হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল তা জানে। তাই নাম শুনে চমকে উঠল বলল, তুমিই তাহলে কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল?
হ্যাঁ লেখা পড়া করার জন্য আমি ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। ঐ লোকটা বলল, তারা দু’তিন বছর আগে মারা গেছে। কথা শেষ করে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
দাইহান বলল, কেঁদে আর কী করবে? চল ঘরে চল।
তারপর যেতে যেতে বলল, তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর চাচা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাচিকে নিয়ে চলে আসে। তারপর কিভাবে তারা মারা গেল বলে বলল, আমি তোমার আব্বার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। দাদিকে নিয়ে এখন তোমাদের ঘরে থাকি। তুমি ঢাকায় এতদিন কি করতে?
একজনের বাড়িতে থেকে এস.এস.সি পাশ করেছি।
তাই নাকি? তাহলে তো খুব ভালো কথা। দাদি তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে। ঘরের উঠানে এসে দাইহান বড় গলায় বলল, দাদি কে এসেছে দেখবে এস।
কাজেমের ঝুপড়ির মতো একটা ঘর ছিল। দাইহান সেটাকে মেরামত করে দাদিকে নিয়ে থাকে। ঘরের বাইরে দরজার পাশে তালপাতার বেড়া দিয়ে অল্প একটু জায়গা ঘিরে দিয়েছে। সেখানে রহিমন দাদি মাটির চুলোতে রান্না করে। একটু আগে মোড়লদের পুকুর থেকে কলমী শাক তুলে এনে চুলোর কাছে বসে কুটছিল। নাতির গলা পেয়ে মুখ বাড়িয়ে সাথে একটা ভালো জামা কাপড় পড়া ছেলে দেখে বলল, কে রে ছেলেটা?
ততক্ষণ তারা তার কাছে চলে এল। দাইহান বলল, যে ছেলের শোকে কাজেম চাচা পাগল হয়ে মারা গেল, এই সেই ইকবাল।
রহিমন কী বললি বলে বেরিয়ে এসে ইকবালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ তাই তো, দেখতে ঠিক কাজেমেরই মতো? তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দাইহানকে জিজ্ঞেস করল, তুই একে পেলি কোথায়?
দাইহান বলল, কাজ না পেয়ে ফিরে আসছিলাম। দেখি মুন্সী চাচার সঙ্গে কথা বলছে। সে ইকবালকে চাচা চাচির মরণের কথা বলেছে। আমাকে দেখে মুন্সী চাচা বললেন, “এই ছেলেটা কাজেমের খোঁজ করছে।” আমি ওর সঙ্গে কথা বলে কাজেম চাচার ছেলে জেনে নিয়ে এলাম।