রাবেয়া বসে বলল, ডাক্তার নিয়ে পলাশপুর গিয়েছিলি?
হ্যাঁ গিয়েছিলাম। গিয়ে খুব বড় বিপদে পড়েছিলাম। নেহাৎ হায়াৎ ছিল বলে আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
রাবেয়া ভয়ার্তস্বরে বলল, তাই নাকি? কি হয়েছিল বলতে শুনি।
রুকসানা ষাঁড়ের ঘটনাটা বলে বলল, ঠিক সময় মতো হাসান স্যার যদি না এসে পড়তেন, তা হলে ষাঁড়টা শিং দিয়ে গুতিয়ে মেরেই ফেলত।
রাবেয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এইজন্যে লোকে বলে, “রাখে। আল্লাহ মারে কে?” তারপর বলল, কায়সারের মুখে শুনেছি, হাসান স্যার শুধু খুব ভালো টিচারই নন, এই কয়েক মাসের মধ্যে ডাক্তার হিসাবে গরিবদের মা বাপ হয়ে গেছেন। তা তোর কেমন মনে হল?
আমার দৃষ্টিতে ওঁর মতো লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
প্রশংসার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেল না?
তা জানি না। যা মনে হয়েছে তাই বললাম।
মনে হচ্ছে ভদ্রলোক তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করে তোর মনের গহীনে ঢুকে পড়েছেন।
কি যা তা বকছিস? যা সিটে গিয়ে কাজ কর।
তা যাচ্ছি বলে রাবেয়া জিজ্ঞেস করল, আসিয়া বলল, কে একজন দাড়িওয়ালা দ্রলোক নাকি এসেছিলেন?
রুকসানা বলল, হ্যাঁ ঐ ভদ্রলোকই গতকাল বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। তারপর টেবিলের উপর প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তাই আঘাত পেয়েছি মনে করে ওষুধ দিতে এসেছিলেন।
তাই নাকি? তা হলে তো ভদ্রলোকের মনেও তুই ঢুকে পড়েছিস?
দেখ, বেশি বাজে কথা বলবি না বেরো এখান থেকে।
রাবেয়া যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলল, দেখবি, বাজে কথাটাই একদিন সত্য হয়ে দাঁড়াবে।
রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কাজে মন দিল।
৩. কিশোর ইকবাল
কিশোর ইকবাল আব্বার হাতে মার খেয়ে সুস্থ হওয়ার পর প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করে হোক রুকসানাকে বিয়ে করে এর প্রতিশোধ নেবে। তাই সুস্থ হওয়ার পর মায়ের জমানো সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বাবা মাকে না জানিয়ে ঢাকা চলে এল। শহরে কয়েকটা বাসায় লজিং এর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ভাবল, শহরের কাছাকাছি কোনো গ্রামে চেষ্টা করতে হবে। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মাণ্ডা হায়দার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে বারান্দায় বসেছিল।
স্কুলের ঘণ্টা পড়ার পর যখন ছেলেরা সব ক্লাসে গেল তখন হেড মাস্টারের কাছে গিয়ে বলল, আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার রোল নাম্বার এক। ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছি। সব ক্লাসেই আমার রোল নাম্বার এক ছিল। আমার আব্বা খুব গরিব। আমাকে পড়াতে চায় না। তাই পড়াশোনা করার জন্য বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আপনি দয়া করে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে নিন। তারপর হেডমাস্টারের দু’পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
হেডমাস্টারের মনে দয়া হল। ভাবলেন, রোল নাম্বার যখন এক এবং ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছে তখন নিশ্চয় ভালো ছাত্র। বললেন, কাঁদছ কেন উঠে দাঁড়াও।
ইকবাল দাঁড়িয়ে চোখ মুছল।
হেড মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
ইকবাল হোসেন।
বাড়ি কোথায়?
গোপালগঞ্জ জেলায়।
কোন স্কুলে পড়তে?
ফুকরা হাইস্কুলে।
স্কুলে না হয় ভর্তি করে নিলাম; কিন্তু তুমি থাকবে কোথায়?
কয়েক দিন স্কুলে থাকার অনুমতি দিন, তারপর লজিং খুঁজে নেব।
হেড মাস্টার তাকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকদের কমনরুমে এলেন। তখনও তারা ক্লাসে যায় নাই। ইকবালকে দেখিয়ে তাদেরকে বললেন, গোপালগঞ্জ জেলার ফুকরা হাই। স্কুলের সেভেনে পড়ে। বাবা খুব গরিব। পড়াতে চায় না। তাই ঢাকায় এসেছে। পড়াশোনা করার জন্য। রোল নাম্বার এক এবং ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছে বলছে। আমরা যদি ওকে একটু সাহায্য করি, তাহলে হয়তো ছেলেটা উন্নতি করবে।
কেউ কিছু বলার আগে এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার বললেন, এরকম ছেলেকে সাহায্য করা আমাদের সকলের কর্তব্য। আপনি ওকে ভর্তি করে নেন।
হেড মাস্টার বললেন, শুনে খুশি হলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও থাকবে কোথায়? খাবে কি?
সেখানে দপ্তরী খালেক ছিল, বলল, ও আমার কাছে আপাতত থাকুক। পরে একটা লজিং ঠিক করে দেব।
হেডমাস্টার হাসানকে ভর্তি করে বই খাতার ব্যবস্থা করে দিলেন।
দপ্তরী খালেকের অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। রাস্তার ধারে চার পাঁচটা দোকানের ভাড়া পায়। পৈত্রিক সূত্রে যে জায়গা পেয়েছে সেখানে টিন সেডে চার কামরা ঘর করেছে। দু’কামরা ভাড়া দিয়েছে। বাকি দু’কামরায় নিজেরা থাকে। তার স্ত্রী ফরিদা একটু মুখরা হলেও আচার ব্যবহার ভালো। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা বড়। নাম রেফাত। মেয়ের নাম মালেকা। রেফাত ফোরে আর মালেকা টুয়ে পড়ে।
ছুটির পর খালেক ইকবালকে বাড়িতে নিয়ে এসে ছেলেদের পড়ার রুমে বসাল। তারপর স্ত্রীর কাছে গিয়ে ইকবালের সব কথা বলে বলল, পোলাডা খুব ভালা, তাই। লইয়া আইলাম। রেফাত ও মালেকাকে পড়াইব আর আমাদের লগে থাকবো। তুমি। তো ওদের লাইগ্যা মাস্টার রাখনের কথা কইছিলা। পাঁচশ টাকার কমে কেউ বাড়িতে পড়াইবার আইত চায় না। লজিং মাস্টার বাড়িতে রাখলে তিন বেলা ভালামন্দ খাওন দেওয়া লাগবো, থাকনের রুম লাগবো। এই পোলাড়া কতই বা আর খাইবো? রেফাতের লগে একরুমে থাকবারও পারবো।
স্বামীর কথা শুনে ফরিদা বলল, কইলাতো ভালাই, চলো তো দেহি। তারপর স্বামীর সঙ্গে এসে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আহারে, পোলাডা বুঝি হারাদিন খায় নাই। মুখ শুকিয়ে তুলসী পাতার ল্যাহান হইছে। তারপর স্বামীকে বলল, তুমি পোলাডারে কলতলায় লইয়া যাও। হাতে পায়ে পানি দিয়া নিয়া আইস, আমি ভাত নিয়া আহি।