রুকসানা বলল, হ্যাঁ আব্বা।
আব্দুল মতিন বললেন, পরামর্শ নিতে এসে তার কথা বলছিস কেন?
রুকসানা বলল, সে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। পড়ে শোনাচ্ছি। শোনার পর তোমরা পরামর্শ দেবে। তারপর চিঠিটা পড়ে শোনাল।
পড়া শেষ হওয়ার পর আব্দুল মতিন ও আজিজা বেগম অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন।
রুকসানা বলল, তোমরা কিছু বলছ না কেন?
আব্দুল মতিন সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, আজকালের ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার আগেই এমন কিছু ছেলেমানুষি কাজ করে ফেলে, যা তাদের করা মোটেই উচিত নয়।
কিন্তু আব্বা ছোটরাই তো ছেলেমানুষি করে। তাছাড়া বড়রাও অনেক সময় ভুল করে থাকে।
তোর কথা অস্বীকার করব না, তবে কি জানিস মা, বড়রা যা ভুল করে, তা সংশোধনের চেষ্টাও তারা করে। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্করা তাদের ভুল যেমন স্বীকার করে না, তেমনি সংশোধন করার কথা মানতেই চায় না।
তা হয়তো ঠিক। এখন আমি কিভাবে আমার সইকে বাঁচাব তার পরামর্শ দাও।
খুব চিন্তায় ফেলে দিলি মা, ভেবে চিন্তে দেখি কি করা যায়। আচ্ছা, চিঠিটা তুই পেলি কি করে? ডাকে এসেছে?
না, আসমা তার ভাইয়ার হাতে পাঠিয়েছে। তার হাতে দুলাইন লিখে দিতেও বলেছে। তাই নিচে বসিয়ে রেখেছি।
তার ভাইয়াকে তুই চিনিস?
হ্যাঁ।
গেঁদু মুন্সীর ছেলেমেয়ে কটা?
এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বড়।
তাকে নাস্তা দিতে কাউকে বলেছিস?
হ্যাঁ সামসু চাচাকে বলেছি।
আব্দুল মতিন চিন্তা করলেন কিছু একটা করা উচিত। নচেৎ চিঠিটা যেভাবে লিখেছে, যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে বসে? বললেন, চলতো তার সঙ্গে কথা। বলে দেখি।
শাকিল আব্বার মুখে বাহিরবাগ গ্রামের চৌধুরীদের পূর্বপুরুষদের দূর-দবার কথা অনেক শুনেছিল। জমিদারী চলে গেলেও এখনো তাদের প্রতিপত্তি যে কমেনি তাও। শুনেছে, আব্দুল মতিন চৌধুরী যে দশ গ্রামের বিচার আচার করেন তাও জানে। নাস্তা খেয়ে ঘরের দামি দামি আসবাবপত্র দেখছিল। রুকসানার সঙ্গে একজন লোককে আসতে দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় ওর আব্বা আব্দুল মতিন চৌধুরী। দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি রুকসানার আব্বা, ওর মুখে তোমার পরিচয় পেয়েছি। তুমি কতদূর। লেখাপড়া করেছ?
শাকিল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে আর পড়িনি। আমার মাথা মোটা, তাই আব্বাও পড়ায় নি।
বড় ভাই হয়ে ছোটবোনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে কেন?
শাকিল উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
তোমার বন্ধুর কি নাম যেন?
দাইহান। সে কতদূর লেখাপড়া করেছে?
সেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছে।
তোমাদের বন্ধুত্ব কতদিনের?
ছোট বেলা থেকে।
দাইহান কার ছেলে?
ফজল শেখের।
তার অবস্থা কেমন?
ভালো না। জমি জায়গা অল্প।
তোমার আব্বা তো ঠিক কথা বলেছেন, দাইহান তোমার বন্ধু হতে পারে, তাই বলে জেনে শুনে নিজের শিক্ষিত বোনকে একটা অল্প শিক্ষিত গরিব ছেলের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও কেন? তা ছাড়া তোমার বাবার অবস্থা ভালো। তার মান সম্মান আছে।
শাকিল বলল, আমি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বুঝি না। আমার একটাই বোন। তাকে খুব ভালোবাসি। সে যাকে পেয়ে সুখী হতে চায়, তার হাতেই দিতে চাই। আর দাইহান গরিব অশিক্ষিত হলেও তার মতো ভালো ছেলে আমি দেখিনি। তাছাড়া আব্বার সম্পত্তি অনেক। আব্বা অন্য ছেলেকে যা কিছু দিতে চাচ্ছে, তা দাইহানকে দিলে সে আর গরিব থাকবে না।
আব্দুল মতিন বুঝতে পারলেন শাকিলের সত্যি মাথা মোটা, আর খুব সহজ সরল। বললেন, কিন্তু তোমার আব্বা তো দাইহানকে পছন্দ করেন না। মা-বাবারা ছেলে মেয়েদের ভালো চান। তোমার আব্বার কথা তোমাদের মেনে নেয়াই তো উচিত।
উচিত অনুচিত বোঝার জ্ঞান থাকলে আপনাদের কাছে আসতাম না। তারপর উঠে এসে আব্দুল মতিন চৌধুরীর পায়ে হাত দিয়ে বলল, আপনি আমার বোনকে বাঁচান। তার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারব না।
আব্দুল মতিন তার হাত ধরে তুলে বসতে বলে বললেন, আসমা আমার মেয়ের সই। তাকে আমিও মেয়ের মতো মনে করি। তুমি এখন যাও। আমি কাল তোমার আব্বার সঙ্গে দেখা করব।
শাকিল সালাম বিনিময় করে চলে এল। ঘরে এসে আসমাকে সব কথা জানিয়ে বলল, চিন্তা করিস না। আমার মনে হয়, চৌধুরী হুজুর আব্বাকে রাজি করাতে পারবেন।
পরের দিন আব্দুল মতিন দক্ষিণ ফুকরায় গিয়ে গেঁদু মুন্সীকে কি বলেছিলেন তা রুকসানা জানে না। ফিরে এসে শুধু বলেছিলেন, এমন ব্যবস্থা করে এসেছি গেঁদু মুন্সী গুপিনাথপুরের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়ে দাইহানকে জামাই করতে রাজি হয়েছে।
মাস খানেক পরে গেঁদু মুন্সী নিজে এসে আব্বাকে দাইহানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। আব্বা নিয়েও গিয়েছিলেন। এক সময় আসমাকে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা এসে তোর আব্বাকে কি করে রাজি করাল বলতো।
আসমা বলল, আমি জানিনি। ভাইয়া বলল, চৌধুরী চাচা খুব নামি দামি লোক। উনি যা যা বললেন আব্বা সব মেনে নিলেন।
রুকসানা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে এইসব ভাবছিল। এমন সময় রাবেয়া এসে তাকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে কপালে একটা হাত রেখে বলল, কিরে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
রুকসানার মনে হল এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল, রাবেয়ার কথায় তা ভেঙ্গে গেল। তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, না শরীর ভালো আছে। এমনি একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল আর কি? তুই বস।