এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাস খানেক পর একদিন আসমার ভাইয়া শাকিল রুকসানাদের সদর বাড়িতে এসে একজন লোককে বলল, আমি দক্ষিণ ফুকরা থেকে এসেছি, চৌধুরী হুজুরের বড় মেয়ে রুকসানার কাছে।
লোকটা সামসু। জিজ্ঞেস করল তোমার নাম কি?
শাকিল।
কার ছেলে তুমি?
গেঁদু মুন্সীর।
তোমাদের নাম বললে বড় আপা চিনবেন?
জি চিনবেন।
ঠিক আছে, বস, আমি খবর দিচ্ছি। তারপর ভিতর বাড়িতে গিয়ে রুকসানাকে বলল, দক্ষিণ ফুকরা থেকে গেঁদু মুন্সীর ছেলে শাকিল আপনার কাছে এসেছে।
রুকসানা বলল, নিচে ড্রইংরুমে বসাও আমি আসছি।
শাকিলও দাইহান সময় পেলেই মাঝে মধ্যে ছুটির সময় স্কুলে এসে আসমাকে নিয়ে যেত। প্রথম যেদিন আসে, সেদিনই আসমা রুকসানার সঙ্গে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাই শাকিল এসেছে শুনে ভাবল, নিশ্চয় আসমা পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ড্রইংরুমে এল।
শাকিল সালাম দিল।
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার শাকীল ভাই, হঠাৎ এলে যে?
শাকিল বলল, আব্বা দাইহান ও আসমার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে গুপিনাথপুরে আসমার বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছে। তারপর পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তুমি তো ওদের কথা সবই জান। তাই আসমা তোমার কাছে সাহায্য চেয়ে এটা দিয়েছে।
আসমার চিঠিটা নিয়ে বলল, তুমি বস, আমি আসছি। তারপর যাওয়ার সময় সামসুকে বলল, চাচা, একে নাস্তা দাও। উপরে নিজের রুমে এসে চিঠি পড়তে লাগল–
সই,
সালামান্তে আন্তরিক ভালোবাসা নিস। আশা করি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছিস। কামনাও তাই। তারই কৃপায় আমিও ভালো আছি। পরে জানাই যে, আব্বা আমার ও দাইহানের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়ে একদিন আমাকে খুব রাগারাগি করে। তারপর গোপনে গুপিনাথপুরে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিছু দিন আগে ঐ পাত্র দেখতে এসে অনেক কিছু দাবি করেছিল বলে আব্বা, রাজি হয়নি। এখন তাদের সব। দাবি মেনে নিয়েছে। তুই তো জানিস দাইহান ভাইয়ার বন্ধু। আর ভাইয়া যে আমাকে কত ভালবাসে তাও জানিস। তাই অনেক সময় আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ভাইয়া দেখে ফেললেও কখনো কিছু বলেনি। বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে জেনে ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা যে তোর বিয়ে ঠিক করেছে, জানিস? আমি বললাম না। তারপর ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। ভাইয়া বন্ধুর হাতে আমাকে দিতে চায়। তাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বলল, আমি যদি আগে জানতে পারতাম, তাহলে আব্বাকে এটা করতে দিতাম না। আমাকে যখন আব্বা জানাল তখন অনেক কিছু সুবিধা অসুবিধার কথা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে দাইহানের সঙ্গে বিয়ে দিতে বললাম। শুনে আব্বা ভাইয়াকে খুব রাগারাগি করে বলল, তুই মূর্খ। লেখাপড়া না করে একটা গাধা হয়েছিস। নচেৎ নিজের শিক্ষিত বোনকে একটা মূর্খ কামলার সাথে বিয়ে দিতে চাইতিস না। বংশের মান ইজ্জতের জ্ঞান ও তোর। নেই। যদি থাকত, তাহলে তুই কামলার পুত কামলার সঙ্গে বন্ধুত্বও করতিস না। তাকে আমার সীমানায় আসতে নিষেধ করে দিস। কামলার পুতের এতবড় সাহস, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। এ ব্যাপারে যদি আর একটা কথা বলিস, তাহলে তোকে ত্যাজ্যপুত্র করব। এই পর্যন্ত বলে ভাইয়া চোখ মুছে বলল, আমি তোদের জন্য বোধহয় কিছুই করতে পারব না। হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল, ভাবলাম, আমার বিপদের কথা শুনে তুই নিশ্চয় সাহায্য করবি। তাই এই চিঠি লিখে ভাইয়াকে পাঠালাম। তুই তো জানিস, দাইহানকে ছাড়া আমি বাঁচব না। অন্য জায়গায় বিয়ে। হওয়ার আগে বিষ খাব। আমি আত্মঘাতী হব, এটা সই হয়ে নিশ্চয় চাইবি না। তাই যা কিছু করার একটু তাড়াতাড়ি করিস। একজন আত্মঘাতাঁকে বাঁচালে আল্লাহ নিশ্চয়। তোকে সুখী করবেন। আমি ক্রমশ মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। কি লিখলাম না লিখলাম বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার হাতে যা হোক কিছু দু’লাইন লিখে দিস। জীবনে তোর সাথে আর দেখা হবে কিনা আল্লাহ মালুম। আর কলম চলছে না আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোর প্রাণপ্রিয় সই
আসমা।
চিঠি পড়ে রুকসানা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে চিন্তা করল, কিভাবে আসমাকে বাঁচাবে। কিন্তু কোনো কিছুই মাথায় এলনা। হঠাৎ মনে হল, আব্বাকে জানালে কেমন হয়? আসমাকে ভালোভাবেই চিনে। নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। চিঠিটা হাতে নিয়ে আব্বার ঘরে গেল।
আব্দুল মতিন স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। মেয়েকে দেখে বললেন, আয় বস।
রুকসানা আব্বার পাশে বসে বলল, একটা ব্যাপারে তোমার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছি শুনে রেগে যাবে না বল?
প্রথম সন্তান বলে আব্দুল মতিন রুকসানাকে অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য সব মা বাবাই তা করে থাকেন। আব্দুল মতিন মৃদু হেসে বললেন, পরামর্শ চাইবি এতে রাগ করব কেন? তাছাড়া আমি বা তোর মা। কোনোদিন তোকে রাগারাগি করেছি?
রুকসানা মা-বাবা দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলল, আমার সই আসমার কথা তোমাদের মনে আছে?
আজিজা বেগম বললেন, মনে থাকবে না কেন? সে তো অনেকবার তোর সঙ্গে এসেছে। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে এসে আমাদেরকে সালাম করে দোয়া নিয়ে গেল।
স্ত্রী থেমে যেতে আব্দুল মতিন বললেন, আমারও মনে আছে, দক্ষিণ ফুকরার কৃপন গেঁদু মুন্সীর মেয়ে তো?