মনিরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, মাগরিবের আজান হচ্ছে শুনে রুকসানা বলল, যা নামায পড়তে যা, আমিও পড়ব।
পরের দিন রুকসানা অফিসে কাজ করছিল। পিয়ন আতাহার এসে একটা স্লিপ দিয়ে বলল, এই ভদ্র লোক আপনার সাথে দেখা করতে চান।
রুকসানা স্লিপের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, নিয়ে এস।
হাসান রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বলল, ভালো আপনি?
আমিও ভালো বলে হাসান পকেট থেকে একটা ছোট ওষুধের প্যাকেট বার করে। টেবিলের উপর রেখে বলল, দিনে কয়েক ফোঁটা করে চারবার খাবেন। প্যাকেটের ভিতর ড্রপারও আছে।
রুকসানা অবাক কণ্ঠে বলল, ওষুধ খাব কেন?
কাল পড়ে গিয়ে নিশ্চয় আঘাত পেয়েছিলেন। লজ্জায় আমার কাছে স্বীকার করেন নি। এটা পঞ্চাশ হাজার পাওয়ারের আরনিকা। খেলে যে কোনো আঘাতের ব্যথা সেরে যায়।
আমি তো তেমন আঘাত পাইনি, তবু খেতে হবে?
হ্যাঁ, তবু খেতে হবে। কারণ আঘাত পাওয়া জায়গাটা বেশি বয়সে অসুবিধা সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে যদি কেউ ছোট বেলায় অথবা বড় বেলায় মাথায় আঘাত পায়। তাহলে বয়সকালে সে পাগলও হয়ে যেতে পারে।
রুকসানা আরো অবাক হয়ে বলল, আপনি ডাক্তার নাকি?
এই একটু-আধটু প্র্যাকটিস করি আর কি।
তাই বলুন। আপনার কথা শুনে মনে করেছিলাম, আপনি পাশ করা ডাক্তার। তারপর বলল, আপনি এসে ভালই করেছেন। নচেৎ আমাকেই আপনার কাছে যেতে হত।
তাই নাকি? তা হলে কারণটা বলুন।
মনিরাকে চেনেন? আপনার স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী।
ছাত্রীকে চিনব না কেন?
কতটা চেনেন?
ভালো ছাত্রী, তবে অঙ্কে একটু কাঁচা। আর একটু চঞ্চল।
মনিরা আমার ছোট বোন। আপনি ঠিকই বলেছেন, ও অঙ্কে একটু কাঁচা, পাকা করার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য আপনার কাছে একদিন যাব ভাবছিলাম।
দেখুন, আমি কোনো ছাত্র ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াই না। তা ছাড়া এখান থেকে দক্ষিণ ফুকরা প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের কম না?
বাড়িতে এসে পড়াবেন, একথা তো বলিনি। ছুটির পর স্কুলেই পড়াবেন।
তাও সম্ভব নয়।
কেন?
স্কুলের টাইমের আগে ও পরে ডাক্তারী করি। পড়াবার সময় কোথায় বলুন।
ডাক্তারী করে মাসে কত আয় করেন?
আয় করার জন্য আমি ডাক্তারী করি না।
মানে?
মানে গ্রামের অভাবী লোকদের সেবা করা।
বাড়িতে কে কে আছে আপনার?
কেউ নেই।
রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছি, আপনার বাড়ি কোথায়?
হাসান দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বলল, হয়তো আমার মতো কাউকে কোথাও দেখেছেন। এবার আসি তাহলে?
রুকসানা বলল, প্লিজ, আর একটু বসুন। তারপর মেয়ে পিয়ন আসিয়াকে ডেকে বলল, দু’কাপ চা করে নিয়ে এস। তারপর হাসানকে বলল, বাড়ি কোথায় বললেন না যে?
বাড়ি থাকলে তো বলব।
ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা করব কেন? যা সত্য তাই তো বললাম।
জন্মস্থানের নাম নিশ্চয় জানেন।
জানি।
সেটাই বলুন।
বলতে পারব না।
কেন?
মাফ করবেন, তাও বলতে পারব না।
এমন সময় আসিয়া দু’কাপ চা নিয়ে এলে রুকসানা এক কাপ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন। তারপর অন্য কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, মনিরাকে তাহলে সাহায্য করতে পাবেন না?
হাসান কোনো কথা না বলে চা খাওয়া শেষ করে কাপ পিরিচ টেবিলের উপর রেখে বলল, ঠিক আছে, ছুটির পর স্কুলেই ঘণ্টাখানেক পড়াতে পারি। অবশ্য মনিরা যদি পড়তে চায়।
সে ব্যবস্থা আমি করব। আপনি থাকেন কোথায়?
ফুকরা স্কুলে জয়েন করার পর কিছু দিন সেক্রেটারীর কাঁচারী বাড়িতে ছিলাম। তারপর দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের মরহুম কাজেম সেখের ভিটায় দু’টো ঘর তুলে আছি। একটা ডিসপেন্সারী আর অন্যটাতে আমি থাকি।
কাজেম সেখের নাম শুনে রুকসানা চমকে উঠল। সেই সাথে ইকবালের কথা মনে পড়ল। হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, ইকবালের মুখের সঙ্গে অনেক মিল। ভাবল, তাই বোধ হয় হোসেনকে চেনাচেনা মনে হচ্ছে। বলল, ঠিক আছে মনিরা ছুটির পর স্কুলেই আপনার কাছে পড়বে।
এবার তাহলে আসি। ওষুধটা ঠিক মতো খাবেন বলে, ইকবাল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
রুকসানা বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। কাল ঘরে এসে আব্বা-আম্মাকে আমার বিপদের কথা বলে আপনি কিভাবে। আমাকে রক্ষা করলেন বললাম। শুনে তারা আপনাকে অনেক দোয়া করলেন। তারপর আমাকে বললেন, আবার দেখা হলে নিয়ে আসবি। চলুন না, আমাদের বাড়িতে।
ইকবাল বলল, আজ সম্ভব নয়, অন্য একদিন আমি নিজেই যাব। তারপর সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
হাসান স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পর রুকসানার কেন যেন মনে হল, উনি ইকবাল নয় তো? প্রায় বিশ বছর তাকে দেখিনি, তার উপর দাড়ি রেখেছে। তাই হয়তো চিনতে পারিনি। তা না হলে স্কুল থেকে তিন চার কিলোমিটার দূর দক্ষিণ ফুকরায় কাজেম চাচার ভিটেয় ঘর তুলে থাকতে যাবে কেন? হঠাৎ আসমার কথা মনে পড়ল। দাইহানের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সে তো কাজেম চাচার ঘরের পাশে আছে। খবর দিলে দু’জনেই আসবে। তাদের কাছে হাসান স্যারের পরিচয় নিশ্চয় জানা যাবে। আমি তাদের বিয়ের ব্যাপারে যে সাহায্য করেছি সে কথা মনে রাখলে তারাও আমাকে সাহায্য না করে পারবে না। তখন তাদের বিয়ের ঘটনা রুকসানার মনের পাতায় ভেসে উঠল।