- বইয়ের নামঃ বড় আপা
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী।
- বিভাগসমূহঃ ধর্মীয় বই
১. আশ্বিনের আধা-আধি
বড় আপা
কাসেম বিন আবুবাকার
উৎসর্গ
আমার অতি প্রিয় একজন
হাফেজ ও মুফতী দেলওয়ার হোসেন
“আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান করেন। আর যে ব্যক্তি ধর্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়, সে অতি কল্যাণের বস্তু প্রাপ্ত হইল। বস্তুত ও নসীহত তাহারাই কবুল করে যাহারা বুদ্ধিমান।”
(২) “কারও শত্রু জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান হওয়া তার জন্য একটি সৌভাগ্য।”
.
০১.
আশ্বিনের আধা-আধি। গ্রামের পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, নদী-নালা, মাঠ-ঘাট পানিতে থৈ-থৈ করছে। মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ। ধানগাছগুলো বাতাসে ঢেউ তুলে মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করছে। ধান গাছের এখন ভরা যৌবন। চাষীরা বলে ধান গাছ পোয়াতি হতে শুরু করেছে। দু’দিন খুব গুমোট ছিল। আজ বিকেল থেকে আকাশে কুচকুচে কালো মেঘ সাজতে শুরু করল। তাই দেখে গ্রামের বৌড়ী-ঝিউড়ীরা হাঁস-মুরগী খোয়াড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যাদের হাঁস খাবারের সন্ধানে মাঠে ছিল, তারা মাঠের ধারে এসে চই-চই শব্দ করে ডাকতে লাগল। রাখালেরা গরু-বাছুর গোয়ালে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ঠিক মাগরিবের আজানের আগে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। সে কি ভীষণ ঝড়। বহু গাছ-পালা উপড়ে পড়ল। অনেক কাঁচা বাড়ি নষ্ট হল। অনেকের ঘরের টিনের চাল। উড়ে গেল। মাগরিব ও এশার নামায পড়তে কেউ মসজিদে যেতে পারল না। মসজিদের পাশে ইমাম সাহেব ও মোয়াজ্জেন সাহেবের থাকার ঘর। তারাও মসজিদে যেতে পারলেন না। থাকার ঘরের ভিতরেই আজান দিয়ে নামায পড়লেন।
গোপালগঞ্জ জেলার বাহিরবাগ গ্রামের আব্দুল মতিন চৌধুরী খুব অবস্থাপন্ন। গৃহস্থ। তার দাদাজী আব্দুস সাত্তারের নানারা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাদের কোনো বোন ছিল না। তারা ছিলেন জমিদার। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইয়ের এক ছেলে ও সেজ ভাইয়ের এক মেয়ে ছাড়া আর কারো সন্তানাদি হয়নি। সব ভাই একান্নবর্তী পরিবারে বাস করতেন। পাঁচ ভাই ও তাদের বৌয়েদের মধ্যে খুব মিলমিশ ছিল। যা কিছু করতেন সব ভাই পরামর্শ করে করতেন। ছোট ভাইয়েরা বড় ভাইকে বাবার মতো সম্মান করতেন। জায়েরাও সংসারের কাজ-কর্ম মিলে মিশে করতেন। ছোট জায়েরা বড় জাকে মায়ের মতো সম্মান করতেন। পাঁচ ভাই ও পাঁচ জা ঐ ছেলে মেয়ে দু’টোকে চোখের মনি মনে করতেন। তারা বড় হওয়ার পর চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে দেন এবং সব বিষয় সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দেন। জমিদাররা সাধারণত প্রজাদের শোষণ করে থাকেন। কিন্তু তারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। প্রজাদের ভালো-মন্দের দিকে খুব লক্ষ্য রাখতেন। কোনো গরিব প্রজার অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতেন। এক এক ভাই যখন খাজনা উসুলের সময় গোমস্তার সঙ্গে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতেন তখন সেখানকার প্রজাদের সঙ্গে তাদের সুবিধা-অসুবিধা আলাপ করতেন এবং অসুবিধাগুলো দূর করার ব্যবস্থা করতেন। যেখানে স্কুল-মাদ্রাসা নেই, সেখানে করে দিয়েছেন। সে সব চালাবার দায়িত্ব নিজেরা বহন করতেন। তখন ইংরেজরা এই দেশ শাসন করত। তারা যখন জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে তখন তাদের জমিদারী চলে যায়। তবু জমি জায়গা তাদের প্রচুর ছিল। সেই সময় আব্দুস সাত্তারের জন্ম হয়। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের সব সম্পত্তির মালিক হন। আব্দুস সাত্তারের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বড়। নাম আব্দুস সালাম। আর মেয়ের নাম খাদিজা। খাদিজা বার বছর বয়সে মারা যায়। আব্দুস সালামের এক মাত্র সন্তান আব্দুল মতিন।
আব্দুল মতিন যে বছর এইচ. এস. সি. পাশ করেন সেই বছর তার বাবা আব্দুস সালাম মারা যান। আব্দুস সাত্তার নাতিকে আরো পড়াতে চাইলেন। কিন্তু আব্দুল মতিন বাবা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনাতে মন বসাতে পারলেন না। সে কথা দাদীজীকে জানিয়ে বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করতে লাগলেন।
আব্দুস সাত্তার নাতির বিয়ের বয়স হলে আজিজা বেগম নামে এক আলেমের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। আজিজা বেগম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেছেন। তাদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। প্রথমে দুই মেয়ে, রুকসানা ও ফারজানা। ফারজানা চার বছর বয়সে মারা গেছে। তারপর পরপর তিন ছেলে, আব্দুর রসিদ, আব্দুস সামাদ ও আব্দুল করিম। সবার ছোট মেয়ে মনিরা। যে বছর মনিরার জন্ম হয় সেই বছর আব্দুস সাত্তার মারা যান। তার এক বছর পর তার স্ত্রীও মারা যান।
আজ পাঁচ বছর হতে চলল স্ট্রোক করে আব্দুল মতিনের ডান হাত ও ডান পা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। চলাফেরা করতে পারেন না। তাই হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন।
রুকসানা দেখতে ভালো হলেও চোখ দুটো খুব বড় ও বেমানান। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার চোখের দিকে তাকালে ভয় পায়। বড়রা ভয় না পেলেও খারাপ মন্তব্য করে। সবাই বলাবলি করে, “চৌধুরী বাড়ির বড় মেয়ের চোখ গরুর চোখের চেয়ে বড়। এতবড় চোখ তারা আর কোনো মানুষের দেখেনি।” তাই আজিজা বেগম তাকে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে দিতেন না। বাহিরবাগে হাই স্কুল থাকায় প্রাইমারী পাশ করার পর রুকসানা প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাশ করে। তারপর গোপালগঞ্জে হোস্টেলে থেকে গোপালগঞ্জ কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেছে। তার তিন ভাইও ঐ কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেছে। বড় আব্দুর রসিদ চাষ-বাস দেখাশোনা করে। মেজ আব্দুস সামাদ বাড়ির কাছা-কাছি বাজারে তিন চার জন কর্মচারী নিয়ে বিরাট একটা মুদিখানা দোকান চালায়। আর ছোট আব্দুল করিম একটা রাইস মিল দেখাশোনা করে। তিন ভাইয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় জনের দু’টো ছেলেমেয়ে। মেজ ও ঘোটর এখনো কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি।