এদিকে গাহিতে গাহিতে মেরির কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া আসিতেছে, পার্শ্বেও চার্লস কিংবা আর কেহ শেরির গ্লাস লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। ক্রমাগত শেরি গ্লাসের মুখচুম্বন করিয়া মেরির গলাটা নিতান্ত সরস এবং মস্তিষ্ক অত্যন্ত সজীব হইয়া উঠিল। উৎসাহের সহিত গভীর রাত্রি পর্যন্ত পিয়ানোর ঝঙ্কার উঠিতে লাগিল।
শেষ হইলে, শয্যায় শয়ন করিয়া সেদিনের মত আজ আর নিদ্রা আসিল না; মেরি অনেক কথা ভাবিল। পুরুষের দল তাহার বড় প্রশংসা করিয়াছে—কেমন করিয়া তাহার শুভ্র পুষ্পকোরকতুল্য অঙ্গুলি কি-বোর্ডের উপর বিদ্যুৎ গতিতে ছুটিয়া যাইতেছিল এবং অঙ্গুলি সংলগ্ন বৃহৎ হীরক-অঙ্গুরীয় মধ্যে মধ্যে ঝকঝক করিয়া এক শোভা দশগুণ করিয়াছিল; কিন্তু সহসা মনে পড়িল হয়ত আর একজনের আরও শুভ্র, আরও সুন্দর, কিন্তু ক্লান্ত এবং অবসন্ন অঙ্গুলি দুইটি এখনও নিঃশব্দে কাগজের উপর দিয়া ধীরে ধীরে লিখিয়া চলিয়াছে। সে হয়ত সমস্ত শুনিয়াছে, হয়ত বা ক্লেশ অনুভব করিয়াছে, কিন্তু প্রতিবিধানের উপায় কৈ? মধু থাকিলে মৌমাছি আসিবেই, ধন থাকিলে তাহার চতুষ্পার্শ্বে লোকসমূহ জড় হইবেই, নূতন সম্বন্ধের বন্ধন যৌবনের অঙ্গ জড়াইয়া উঠিবার স্বতঃ প্রয়াস করিবেই—ইচ্ছা থাকিলেও এ বাঁধন নিজ হস্তে খুলিয়া ফেলা যায় না। মেরি কাতরভাবে উদ্ধারের কামনা এবং প্রার্থনা করিতে করিতে সে রাত্রে ঘুমাইয়া পড়িল।
পরদিন সে লিওর কাছে গিয়া বসিল, লিও লিখিতেছে, কৈ একবারও চাহিয়া দেখিল না। অনেকক্ষণ ধরিয়া মেরি কথা খুঁজিয়া পাইল না—তারপর সাহসে ভর করিয়া বলিল, ‘তোমার আর কত বাকি আছে?’
‘অনেক।’
‘আজ দু-তিনদিন ধরিয়া কি লিখিলে? আমাকে শুনাইবে না?’
এই সময়ে অনবধানতাবশতঃ কলমের মুখে অনেকখানি কালি উঠিয়াছিল; টপ করিয়া একটা বড় রকমের ফোঁটা শুভ্র কাগজের উপর পতিত হইল। লিও খাতাখানা ঈষৎ সরাইয়া কলমের মুখটা মুছিতে মুছিতে বলিল, ‘মেরি, তোমার মুখ দিয়া বড় তীব্র সুরার গন্ধ বাহির হইতেছে; এ গন্ধ আমার সহ্য হয় না—সরিয়া বস। অত কাছে বসিয়া থাকিলে আমার সমস্ত ভুল হইয়া যাইবে।’
একদণ্ডে মেরির চক্ষু দুটি চকচক করিয়া উঠিল; বলিল, ‘আমি তীব্র সুরা পান করি নাই।’
‘হইতে পারে। কিন্তু আমার নিকট ও গন্ধ বড় উগ্র বোধ হইতেছে। তুমি হয় সরিয়া বস, না হয় গৃহে যাও।’
মেরি উঠিয়া দাঁড়াইল। সে চিরকাল আদর ও যত্নের মধ্যে লালিত পালিত। এরূপ তাচ্ছিল্যের কথা শুনা তাহার অভ্যাস নহে। বড় অপমান বোধ হইল। তাহার সমস্ত হৃদয় আত্মাভিমানে পরিপূর্ণ, তাই এ ক্ষুদ্র যুবার কোমল অথচ রীতিমত দৃঢ় ও নির্ভীক সত্য কথা তাহার সমস্ত শরীরে অকস্মাৎ খর বিষের জ্বালা জ্বালাইয়া দিল। দাঁড়াইবার সময় সে ভাবিয়াছিল, খুব দুটো চড়া কথা শুনাইয়া দিবে; মিথ্যাবাদী, অকৃতজ্ঞ প্রভৃতি শব্দগুলা আরোপ করিয়া, তাহার বুকে ছুরির মত বিদ্ধ করিয়া দিবে—তারপর যথারীতি খুব একচোট কলহ করিয়া চিরদিনের মত বিচ্ছেদ করিয়া চলিয়া যাইবে, কিন্তু দাঁড়াইয়া উঠিয়া তাহার শব্দশাস্ত্রের অভিধানটা একেবারে কোথায় হারাইয়া গেল। ভ্রূ কুঞ্চিত করিল, চক্ষু বিস্ফারিত করিল, দন্তে অধর দংশন করিল কিন্তু কথা বাহির হইল না।
সম্মুখের দর্পণে সে চিত্র লিও দেখিতে পাইল। কাছে আসিয়া মেরির উন্নত গ্রীবার এক পার্শ্বে হাত রাখিয়া বলিল, ‘অপমান বোধ হইয়াছে?’
মেরির আত্মাভিমান এবার কথা খুঁজিয়া পাইল। তীব্রকণ্ঠে কহিল, ‘তুমি নীচ এবং ঈর্ষাপরবশ, তাই অপমান করিলে!’
লিও ধীরে ধীরে সরিয়া গেল। কহিল, ‘মেরি, জগতের মধ্যে ঐ দুটি কথা আমার সহ্য হয় না। অমন কথা আর মুখে আনিও না। তুমি অধঃপথে যাইতেছ, তাই সাবধান করিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু তাহার পরিবর্তে ওরূপ মর্মান্তিক কথা শুনিবার বাসনা রাখি না।’
মেরি আরও ক্রুদ্ধ হইল। বলিল, ‘অধঃপথে কি করিয়া গেলাম?’
‘আমার তাই মনে হয়। ভদ্রঘরের স্ত্রীলোক, বিশেষত তুমি একান্তে অত রাত্রি পর্যন্ত যে আমোদ-প্রমোদ করিবে আমার সেটা ভাল বোধ হয় না। লোকেই বা কি বলিবে?’
আবার লোকের কথা! মেরি অস্থির হইয়া উঠিল। কহিল, ‘লোকে কিছুই মনে করে না। তুমি দরিদ্র কিন্তু আমার ধন ঐশ্বর্য আছে, তোমার মত অনবরত পরিশ্রম করিয়া আমার খাদ্য সংগ্রহ করিতে হইবে না, তোমার মত নির্জন গৃহে বসিয়া জনসমাজের নিকট অপরিচিত থাকিলেই বরং লোকে মন্দ বলিবে।’ তাহার পর একটু বিদ্রূপের হাসি হাসিয়া বলিল, ‘লিও, আপনার ভাগ্য দিয়া আমার ভাগ্য গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিও না—পিতা আমার জন্য অভিশাপ এবং মর্মপীড়া রাখিয়া যান নাই—যাহা সুখের,যাহা বাঞ্ছিত, সমস্তই যথেষ্ট দিয়া গিয়াছেন। যাহার এত আছে তাহার পক্ষে দু-দশজন বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করিয়া আমোদ-প্রমোদ করিলে কেহই দুষে না।’
এত কথা মেরি কহিতে জানে, লিও তাহা জানিত না; এত স্নেহ, এত করুণা যে এত তীব্র বিষ ঢালিয়া তাহার সমস্ত চৈতন্য ওলটপালট করিয়া দিতে পারে, সে ধারণা লিও করিতে পারে নাই—তাই নিতান্ত নির্জীব অবসন্নভাবে বসিয়া পড়িল। কোন উত্তর বা কোনরূপ প্রতিবাদ খুঁজিয়া পাইল না। রাগের মাথায় মেরি চলিয়া গেল, তাহা সে দেখিল কিন্তু ফিরাইতে পারিল না, ইচ্ছাও বড় বেশি ছিল না, কিন্তু দুটো কথা বলিতে পারিলে বোধ হয় ভাল হইত।
আপনার কক্ষে পৌঁছিয়া মেরি, একখণ্ড রুমালে মুখ আবৃত করিয়া একটা সোফার উপর বসিয়া পড়িল—সমস্ত শরীরে অগ্নির উত্তাপ বাহির হইতেছে।