সে রাত্রে মেরি সকলকেই নিমন্ত্রিত করিল, সন্ধ্যার পর তাহার বাটীতে খুব সমারোহে ভোজন ব্যাপার সমাধা হইতে চলিল; আহারে বসিয়া মেরি চার্লসের পার্শ্বে উপবেশন করিয়া, মৃদুকণ্ঠে কহিল, ‘তোমার জন্য বড় ভয় পাইয়াছিলাম।’
চার্লস ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘কেন?’
‘বড় কঠিন আঘাত লাগিয়াছিল,—তুমি ভিন্ন আর কেহ বোধ হয় অশ্বপৃষ্ঠে স্থান রাখিতে পারিত না।’
চার্লস বিনয়নম্রকণ্ঠে কহিল, ‘আমার আঘাত আরোগ্য হইয়াছে; আমার জন্য তুমি দুঃখিত হইয়াছিলে, এমন সৌভাগ্য পূর্বে কখন হয় নাই—এত আনন্দও কখনও অনুভব করি নাই—। তোমার করুণা পাইবার জন্য আমি একটা পা কাটিয়া দিতে পারিতাম; আঘাত ত তুচ্ছ কথা!’
সে রাত্রে অনেক শেরি, শ্যাম্পেনের শূন্যগর্ভ বোতল ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল; গভীর রাত্রি পর্যন্ত আপনার পাঠাগারের জানালায় বসিয়া দুঃখিত অন্তঃকরণে লিওপোল্ড বিকৃত জড়িত কণ্ঠের গীতধ্বনি শ্রবণ করিল; পিয়ানোর শব্দ ঝমঝম করিয়া আকাশে উঠিল; কর্কশ কণ্ঠের সহিত মধুর কণ্ঠও কয়েকবার মিশ্রিত হইল। জানালা বন্ধ করিয়া লিও শয্যাশ্রয় করিল,—আজ হৃদয়ে একটু যাতনা বোধ হইতেছিল।
পাঁচ
পরদিন মেরি লিওকে বলিল, ‘কাল আমাদের বাটীতে কেমন উৎসব হইয়া গেল, তোমার সময় ছিল না বলিয়া তোমাকে ডাকি নাই।’
লিও হস্তস্থিত কলম দোয়াতের উপর রাখিয়া দিয়া কহিল, ‘ভালই করিয়াছিলে—কিন্তু আমারও কাল রাত্রে কিছুই কাজ হয় নাই, কিছু ক্ষতি হইয়াছে।’
মেরি মুখপানে চাহিয়া বলিল, ‘কেন কাজ হয় নাই?’
লিও কলম তুলিয়া লইল, পুস্তকে মনঃসংযোগ করিবার উপক্রম করিয়া বলিল, ‘সে কথা তুলিয়া কাজ নাই, আমি বলিতে পারিব না।’
এরূপ কথা জীবনে মেরি এই প্রথম শুনিল। বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘কেন?’
‘তা জানি না; বোধ হয় মন কিছু নীচ হইয়া পড়িয়াছে।’
তাহার পর মেরি অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল, অনেক কথা মনে মনে তোলাপাড়া করিল কিন্তু লিও আর মুখ তুলিল না, কোন কথাই জিজ্ঞাসা করিল না।
মেরি যাইবার সময় বলিল, ‘যাইতেছি।’
‘যাও।’
যাইবার সময় তাহার বোধ হইল যেন সে লিওর মনের কথা কতক বুঝিতে পারিয়াছে, কিন্তু প্রতিপন্ন করিবার উপায় নাই—শুধু অনুমান করা যায় মাত্র। যাহা হউক, ক্ষুদ্র পথটুকু সে বড় অন্যমনস্কভাবে অতিক্রম করিল। বাটীর ভিতের প্রবেশ করিবার সময় ভৃত্য একখানা টিকিট হাতে করিয়া কহিল, চার্লস বসিবার কক্ষে অপেক্ষা করিতেছেন।
মেরি ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ‘কেন?’
‘তাহা জিজ্ঞাসা করি নাই,—জিজ্ঞাসা করিয়া আসিব কি?’
মেরি একটু ভাবিয়া বলিল, ‘থাক, আমি নিজেই যাইতেছি।’
চার্লসের বিশেষ কিছুই কাজ ছিল না। সে শুধু গত নিশির আমোদ-উৎসবের জন্য ধন্যবাদ দিতে আসিয়াছিল। মেরি কক্ষে প্রবেশ করিলে সে অতিশয় ভদ্রতার সহিত অভিবাদন করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মেরি হাত ধরিয়া অতিথিকে বসাইয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিল,—কারণ পূর্বেই বলিয়াছি কিন্তু কথায় কথায় তাহা একটু অন্যরকমে দাঁড়াইতে চলিল।
মেরির কত ঐশ্বর্য, কত বিষয়-আশয়, কত মান-সম্ভ্রম! এই ত হইল প্রথম; তাহার পর মেরি কত উচ্চবংশীয়া, তাহার পিতা কত বড় বীর এবং সজ্জন ছিলেন—রাজদ্বারে তাঁহার যে পরিমাণ সম্ভ্রম ছিল সে পরিমাণের সম্ভ্রম অর্জন করিতে বিশেষ বুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, রাজনৈতিক জ্ঞান প্রভৃতির প্রয়োজন, মেরির পিতা Captain নোলের তাহা কিছুমাত্র কম ছিল না; এক কথায় আজকাল সেরূপ আর মিলে না। কিন্তু শেষের কথাগুলি আরও উচ্চ অঙ্গের, মেরির তাহার খুব ভাল লাগিতেছিল;—সেটা অন্য কিছু নয়, শুধু তাহার নিজের রূপ এবং যৌবনের ব্যাখ্যা এবং পক্ষপাত সমালোচনা। পুরুষের মুখে এ কথাগুলা স্ত্রীলোকের সর্বাপেক্ষা তৃপ্তিকর বোধ হয়, এ কথার কাছে আর কিছুই নয়। তাই কতক্ষণ দুইজনে নির্জন কক্ষে গল্প করিয়া অতিবাহিত করিল তাহা মেরি বুঝিতে পারিল না। ঘড়িতে যখন দুইটা বাজিল তখন চার্লস বিদায় হইল এবং যাইবার সময় সেই দিন সান্ধ্যভোজনের নিমন্ত্রণও লইয়া গেল।
সে চলিয়া গেলে, এই রূপ এবং ঐশ্বর্যের কাহিনীর তরঙ্গগুলা যখন অল্পে অল্পে শান্ত হইয়া আসিতে লাগিল, এবং তাহার প্রতিধ্বনিগুলা মেরির মস্তিষ্কের ভিতর ঠোকাঠুকি করিয়া ক্রমশঃ হীনবল হইয়া ধীরে ধীরে শূন্যে মিলাইয়া যাইতে লাগিল এবং যে অবশিষ্ট স্পন্দনটুকু নাচিয়া বেড়াইতেছিল, তাহাও যখন অন্য আর একটি অসীম সৌন্দর্যের পার্শ্বে কাতরভাবে ছুটিয়া পলাইবার প্রয়াস করিতে লাগিল, তখন তাহার বোধ হইল এই ঝোঁকের উপর আকস্মিক নিমন্ত্রণকার্যটা তেমন যুক্তিসঙ্গত হয় নাই। সন্ধ্যার পর সে আসিবে, দুইজনে একত্র আহার করিতে হইবে, হয়ত বা আর কেহই থাকিবে না, কত গল্প কত কথা বলিবার ও শুনিবার উপায় থাকিবে, কিন্তু মেরির তাহাতে আর তেমন মন উঠিল না। যদি আর কেহ জানিতে পারে? যদি তাহার ক্লেশ বোধ হয়? চঞ্চল হস্তে মেরি এক খণ্ড কাগজ লইয়া লিখিল, ‘তুমি সন্ধ্যার পর আসিও না; আমার শরীর মন্দ বোধ হইতেছে।’ কিন্তু এ পত্র চার্লসের নিকট পাঠাইতে লজ্জা বোধ হইল। অনেক চিন্তা করিয়া মেরি অবশেষে এইরূপ লিখিল, ‘যখন আসিবে তখন আর তিন-চারিজন বন্ধুকে আনিও। আনিতে পারিলে নিতান্ত সন্তুষ্ট এবং সুখী হইব।’ ভৃত্য পত্র লইয়া চলিয়া গেল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে রাত্রে চার্লস আরও দুই-তিনজন বন্ধুকে সঙ্গে আনিল। আহারাদি শেষ করিয়া সকলেই একবাক্যে মেরিকে গান গাহিবার জন্য ধরিয়া বসিল। ইচ্ছা না থাকিলেও অতিথির অনুরোধ রাখিতে হইল; পিয়ানো-এ ঝঙ্কার দিয়া মেরির সুকণ্ঠ দুই-তিনটি সপ্তকের মধ্যে খেলা করিয়া ছুটিতে লাগিল, উৎসাহ ও আনন্দে চার্লস প্রভৃতি কয়েকবার উচ্চ শব্দ করিয়া উঠিল, কেহ বা আবেগের সহিত দুই-এক পদ সঙ্গে সঙ্গে গাহিয়া ফেলিল। ক্রমশঃ শেরি, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি ও রামের শূন্যগর্ভ বোতলগুলির সংখ্যা যত বৃদ্ধি হইয়া চলিল, উৎসাহ, আবেগ, উচ্চস্বর ততই পরিপূর্ণভাবে নৈশ আকাশে ঠেলিয়া ফুঁড়িয়া উঠিতে লাগিল। জানালার ভিতর দিয়া এ শব্দ লিওর পাঠাগারে যে একদম প্রবেশ করে নাই তাহা নহে, কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক আজ লিও জানালাগুলা একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। শব্দ-সাড়াগুলা সেখানে তেমন গোলযোগ করিতে পারিতেছিল না।