মেরি রাগ করিয়া বলিল, ‘তা বলিয়া আমি তোমাকে প্রাণপাত করিয়া পরিশ্রম করিতে কিছুতেই দিব না।’
লিওর মুখে ম্লান ছায়া পড়িল; পিতৃঋণ স্মরণ করিয়া বলিল, ‘আমার অদৃষ্ট! কি করিব মেরি, পরিশ্রম করিতেই হইবে।’
মেরি তাহার মনের কথা বুঝিল, তাই আরো রাগ হইল। বলিল, ‘তোমার পুস্তক আমাকে বিক্রয় করিও—আমি দ্বিগুন মূল্য দিব।’
লিওর তাহাতে সন্দেহ ছিল না; হাসিয়া বলিল, ‘কিন্তু কি করিবে?’
মেরি নিজ গলদেশের বহুমূল্য মুক্তামালা দেখাইয়া বলিল, ‘এই মালা ছিন্ন করিয়া ফেলিব,—যতগুলি মুক্তা, যে কয়খানি হীরক আছে সবগুলি দিয়া পুস্তকখানি বাঁধাইয়া সোনার কৌটায় করিয়া মাথার শিয়রে তুলিয়া রাখিব,—তারপর—তারপর—’
লিও বলিল, ‘তারপর কি?’
মেরি সলজ্জ হাস্যে রক্তিমাভ মুখখানি ঈষৎ নত করিয়া বলিল, ‘তারপর যেদিন রাত্রে খুব বড় চাঁদ উঠিবে, আর তাহার কিরণগুলি তোমার নিদ্রিত মুখের উপর খেলা করিতে থাকিবে, সেই দিন—’
‘সেই দিন কি?’
‘সেই দিন খুব উচ্চকণ্ঠে পাপিয়া ডাকিতে থাকিবে, তোমার কিন্তু কিছুতেই ঘুম ভাঙ্গিবে না, আমি তখন তোমার কানের কাছে বসিয়া’—মেরি হাসিয়া ফেলিল।
লিও বলিল,—’আমার কানের কাছে বসিয়া পুস্তকটিতে যতগুলি কথা আছে, সবগুলি পড়িয়া ফেলিবে, না?’
মেরি মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘হুঁ।’
‘আমি তাহা হইলে জাগিয়া এমনি করিয়া তোমার মুখচুম্বন করিব।’
তাহার পর দুইজনেই হাসিয়া উঠিল।
ঘড়িতে দেড়টা বাজিয়াছে—লিও তাহা দেখিয়া বলিল, ‘ঢের হইয়াছে—এইবার যাও—।’
মেরি জাঁকিয়া বসিল; বলিল, ‘আমার শরীর খারাপ হইয়াছে—আজ যাইব না।’
‘তা কি হয়? কথা দিয়াছ, না যাইলে চলিবে কেন? কত লোক তোমার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।’
মেরি নিতান্ত অবাধ্যের মত কহিল, ‘চুক্তিভঙ্গ হইলে তোমার মত আমার বিশেষ লজ্জাবোধ হয় না—আমি যাইব না।’
‘ছিঃ—যাও।অবাধ্য হইও না।’
‘তবে তুমিও চল।’
‘ক্ষমতায় থাকিলে নিশ্চয় যাইতাম।’
‘ক্ষমতায় আছে—চল।’
‘ক্ষমতায় নাই—যাওয়া অসম্ভব।’
মেরি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,’তবে আমি আর এখানে আসিব না।’
লিও হাসিয়া বলিল, ‘আমি জানি তুমি নিশ্চয় আসিবে।’
মেরি রাগ করিয়া বলিল, ‘আমি না আসিলে তোমার হয়ত খাইবার অযত্ন হইবে। পোড়াপ্রাণে যে এটা সহ্য করতে পারি না, না হইলে নিশ্চয় দুই-এক দিন চুপ করিয়া ঘরের কোণে বসিয়া থাকিতাম।’
‘এ ক্ষমতাটুকু যদি নাই, তবে রাগ করিলে চলিবে কেন?’
কথাটার সত্যতা সম্বন্ধে মেরির অণুমাত্র সন্দেহ ছিল না, তাই ক্ষুণ্ণ অন্তঃকরণে গাড়িতে বসিয়া ভাবিল—সে ছেলেবেলার পড়িয়াছিল যে, উদরের উপর নাকি একদিন হাত-পাগুলা বড় চটিয়া গিয়াছিল—কিন্তু ফল বিশেষ তৃপ্তিজনক হয় নাই।
মেরি তাই রাগ করিতে পারিল না।
চার
দুইটার কিছু পূর্বে যখন মেরির প্রকাণ্ড জুড়ি গাড়ি প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইল তখন সমবেত জনমণ্ডলী বিপুল কলরবে কোলাহল করিয়া উঠিল। সে সুন্দরী, সে যুবতী, সে অবিবাহিতা, এবং বিপুল ধনের অধিকারিণী; মানবের যৌবনরাজ্যে তাহার স্থান অতি উচ্চে; এখানেও বহু মানের আসনটি তাহারই জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সে আজ পুষ্পমাল্য বিতরণ করিবে। তাহার পরে যে তাহার শিরে জয়মাল্যটি প্রথম পরাইতে পারিবে জগতে সেই ভাগ্যবানের অদৃষ্ট আজ হিংসা করিবার একমাত্র বস্তু। সওয়ারগণ রক্তবর্ণ পোশাকে সজ্জিত অশ্বপৃষ্ঠে উৎসাহের বেগ ও চাঞ্চল্য কষ্টে সংযম করিয়া অপেক্ষা করিতেছিল। দেখিলে বোধ হয় তাহারা যেন পর্বতও ভেদ করিতে সক্ষম,—মেরি উপস্থিত হইয়াছে, নির্দিষ্ট সময়ও আসিল,—পিস্তলের শব্দে সকলেই ব্যগ্র হইয়া দেখিল অশ্বশ্রেণী প্রাণপণে ছুটিয়া চলিয়াছে। তাহার পর মেরির নিকট আসিয়া তাহারা অশ্ব সংযম করিল, নিমেষের মধ্যে এক একটি পুষ্পমাল্য হাতে লইয়া আবার ঘোড়া দৌড়াইয়া দিল।—মরিবার সময়টুকু পর্যন্ত তাহাদের নাই। প্রাণ তাহাদের নিকট আজি নিতান্ত তুচ্ছ—শুধু এক কথা মনে জাগিতেছে, কে সর্বপ্রথমে মেরির হস্তে মালা ফিরাইয়া দিতে পারিবে। প্রতি অঙ্গচালনায় শুধু ঐ এক ভাব;—মৃত্যু কিংবা সম্মান! মেরি মনে করিল, সে-ই আজি তাহাদিগের একমাত্র লক্ষ্য। শুধু তাহার নিকট অগ্রে আসিবার জন্য তাহারা প্রাণ দিতে পারে। বালিকাসুলভ আনন্দে এবং যৌবনের চাপল্যে তাহার বুকখানি ঈষৎ ফুলিয়া উঠিল।
ঘোড়া ছুটিয়াছে, সকলেই ব্যগ্রতার সহিত অপেক্ষা করিয়া আছে। কেহ কহিল, ডেভিড প্রথম হইবে; কেহ কহিল, চার্লস আগু হইয়াছে। বিদ্যুতের মত তাহারা অভীষ্ট স্থানে আসিতেছে। ঐ ডেভিড পিছাইয়া পড়িল, চার্লস অগ্রে আসিয়াছে—কেহ কহিল, এখনও কিছু বুঝিতে পারা যায় না; কিন্তু তাহা মুহূর্তমাত্র—পরক্ষণেই স্পষ্ট দেখা গেল, ডেভিড প্রভৃতি পিছাইয়া পড়িয়াছে। চার্লস বিদ্যুতের মত ছুটিতেছে—তাহার পর অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই সে সর্বপ্রথম পুষ্পমাল্য মেরির পদতলে নিক্ষেপ করিল। খুব কোলাহল হইল, অসংখ্য করতালিশব্দ বহু দূর পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইল। চার্লস প্রথম হইয়াছে, মেরি সসম্মানে তাহার হস্ত গ্রহণ করিল।
তাহার পর দ্বিতীয় রেস হইবে;—সওয়ারগণ স্ব স্ব অশ্বে স্থান গ্রহণ করিল। পিস্তলের শব্দে সকলেই কশাঘাত করিয়া অশ্ব ছুটাইয়া দিল—মেরির নিকট হইতে মাল্যগ্রহণ করিবার জন্য সকলেই ছুটিয়া আসিল, সেবার কিন্তু অসাবধানতাবশতঃ চার্লস নীচে পড়িয়া গেল, পশ্চাতের অশ্ব তাহার পদদ্বয়ের উপর দিয়া প্রবল বেগে ছুটিয়া গেল—যাহারা নিকটে থাকিয়া তাহা দেখিল, তাহারা সকলেই চিৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু চিৎকার শব্দ থামিবার পূর্বেই চার্লস লম্ফ দিয়া পুনর্বার অশ্বারূঢ় হইল। পদদ্বয়ে দারুণ আঘাত পাইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহাতে সে ভ্রূক্ষেপও করিল না। অপরাপর অনেকেই চার্লসের জন্য শঙ্কিত হইল; দারুণ আঘাতবশতঃ যদি অশ্বপৃষ্ঠে স্থান না রাখিতে পারে! অজ্ঞাতসারে মেরিও এ সন্দেহ এবং শঙ্কা হৃদয়ে স্থানদান করিল,—প্রথম কারণ তাহার হৃদয় স্বভাবতঃ কোমল, পরদুঃখে শীঘ্রই আর্দ্র হইয়া যায়, দ্বিতীয় কারণটি তাহার বংশগত।বালিকাকাল হইতে সে বীরত্বের বড় পক্ষপাতী, তাহার পিতা-পিতামহ প্রভৃতি সকলেই যুদ্ধব্যবসায়ী ছিলেন। এ সকল গল্প সে বাল্যকালে পিতার নিকট শুনিতে পাইত; অশ্বচালনা যুদ্ধের একটি অংশ,—ইহাতে কত দৃঢ়তা, সাহস এবং সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। যাহা যুদ্ধের অংশ, তাহাই গৌরবের সামগ্রী। সম্মানের নিকট যুদ্ধ-ব্যবসায়ীরা প্রাণকেও নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করে, আজ শুধু সম্মানলাভের জন্যই চার্লস এ আঘাত তুচ্ছ জ্ঞান করিয়াছে—হয়ত বা সে প্রাণ হারাইবে। মেরি শিহরিয়া উঠিল। এইমাত্র যাহার হস্তগ্রহণ করিয়া সম্মানিত করিয়াছে, সে হয়ত প্রাণত্যাগ করিবে; এরূপ চিন্তা হৃদয়-প্রফুল্লকারী নহে, তাই অত্যন্ত আগ্রহ এবং ভীতির সহিত মেরি দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল; চার্লসের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করিল। তাহার পর বড় কোলাহল হইতে লাগিল; দূরবীন লাগাইয়া অনেকেই দেখিল চার্লস পুনর্বার অগ্রে আসিতেছে; কিন্তু ইতিমধ্যে মেরি মনে মনে আপনাকে এই অল্প সময়ের মধ্যেই চার্লসের সহিত এরূপ জড়িত করিয়া লইয়াছিল যে, তাহার এই দুঃসাহসিক কার্যের জন্য আপনাকে নিতান্ত গৌরবান্বিত এবং শ্লাঘ্য বলিয়া বোধ করিল। বাস্তবিক সেবারেও চার্লস জয়ী হইল,—আনন্দে মেরির সহসা বাক্য নিঃসৃত হইল না, পরে নিজের গলদেশ হইতে ঘড়ি ও চেন খুলিয়া লইয়া তাহার গলায় পরাইয়া দিয়া কহিল, ‘তুমি এ গ্রামের রত্ন, তোমার মত সাহসী যুবা আর কেহ নাই।’ চার্লস স্মিতমুখে এ প্রশংসা গ্রহণ করিল।