এ কথার অর্থ সবাই বুঝে,—লিও অন্তরে আশীর্বাদ করিয়া মৃদু কম্পিত-কণ্ঠে বলিল, ‘তাই হউক—জগদীশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন।’
কিন্তু সেবার দুইজনেরই বড় দুর্বৎসর পড়িয়াছিল,—অধিক দিন না যাইতেই ক্যাপ্টান নোল জ্বরবিকারে প্রাণত্যাগ করিলেন। পিতৃ-মাতৃহীন মেরি লিওর বুকে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘লিও শুধু তুমি রহিলে—বিপদে-সম্পদে আমাকে রক্ষা করিও।’
লিও চক্ষু-দুটি মুছাইয়া দিয়া বলিল, ‘করিব।’
‘প্রতিজ্ঞা কর কখন পরিত্যাগ করিবে না।’
‘প্রতিজ্ঞা করিলাম।’
মেরি মুখ তুলিয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘তবে আর কাঁদিব না;—আমার সব আছে।’
দুই
লিও একখানি পুস্তক লিখিয়াছিল। লন্ডন নগরে তাহার একজন বন্ধু ছিলেন। সমালোচনার জন্য হস্তলিখিত পুস্তকখানি তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দেয়। কিছুদিন পরে এইরূপ উত্তর আসিল, ‘বন্ধু, তোমার গৌরবে আমি গৌরবান্বিত হইয়াছি। তোমার লিখিত পুস্তকখানি একজন পুস্তক-প্রকাশকের নিকট কতকটা বাধ্য হইয়া বিক্রয় করিয়াছি। পাঁচ শত পাউন্ড পাঠাইলাম—রাগ করিও না, ভবিষ্যৎ উন্নতির বোধ হয় ইহাই সোপান।’
এ কথা শুনিয়া মেরির চক্ষে জল আসিল,—আনন্দে সে লিওর মুখচুম্বন করিয়া বলিল, ‘লিও জগতে তুমি সর্বপ্রধান কবি হইবে।’
লিও হাসিয়া উঠিল, ‘আর কিছু না হউক মেরি, পিতার ঋণ বোধ হয় পরিশোধ করিতে পারিব।’
মেরি আজকাল স্বয়ং উত্তমর্ণ, তাই এ কথার বড় লজ্জা পাইত। রাগ করিয়া বলিল, ‘এ কথা পুনর্বার বলিলে তোমার কাছে আমি আর আসিব না।’
লিও হাসিল, মনে মনে কহিল, ‘তোমার পিতার নিকট আমার পিতা ঋণী; আমরা দুজনে তাঁহাদের সন্তান, তাই আমি জীবিত থাকিলে এ ঋণ তোমার নিকট পরিশোধ করিবই।’
লিওর আজকাল বড় পরিশ্রম বাড়িয়াছে। নূতন পুস্তক লিখিতেছিল, আজ সমস্ত দিন মুখ তুলিয়া চাহে নাই। মেরি প্রত্যহ যেমন আসিত, আজিও তেমনি আসিয়াছিল। লিওর শয়নকক্ষ, পাঠাগার, বসিবার ঘর প্রভৃতি স্বহস্তে সাজাইয়া গুছাইয়া দিতেছিল। দাসদাসী সত্ত্বেও এ কাজটি মেরি নিজে করিয়া যাইত।
সম্মুখে একখানা দর্পণ ছিল, লিওর প্রতিবিম্ব তাহার উপর প্রতিফলিত হইয়াছিল। মেরি বহুক্ষণ ধরিয়া তাহা দেখিয়া বলিল, ‘লিও তুমি স্ত্রীলোক হইলে এতদিন ইংলন্ডের রানী হইতে।’
লিও হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন?’
‘অত রূপ দেখিয়া রাজা তোমাকে বিবাহ করিয়া সিংহাসনে লইয়া যাইতেন। তোমার মত কৃষ্ণ কুঞ্চিত কেশরাশি আমি আর্ট গ্যালারিতে কোন রাণীর দেখি নাই; এমন শুভ্র কোমল মুখশ্রী কোন্ সম্রাজ্ঞীর ছিল? গোলাপ পুষ্পের মত এমন কোমল মধুময় দেহশোভা স্বর্গে ভিনসেরও ছিল বলিয়া মনে হয় না।’
লিও খুব হাসিয়া উঠিল। কলেজে অধ্যয়নকালেও এমন কথা অনেকে কহিয়াছিল; বোধ হয় তাহাই মনে পড়িয়াছিল। হাসিয়া কহিল,’রূপ যদি চুরি করা যাইত তা হইলে তুমি বোধ হয় এ রূপ চুরি করিয়া আমাকে ফাঁকি দিয়া এতদিনে ইংলন্ডের রানী হইয়া যাইতে।’
মেরি মনে মনে অপ্রতিভ হইয়া সলজ্জ হাসিয়া বলিল, ‘তুমি স্ত্রীলোকের মত দুর্বল, তাহাদের মত কোমল, তাহাদের মতই সুন্দর-তোমার রূপের সীমা নাই।’
এত রূপের নিকট মেরি আপনাকে বড় ক্ষুদ্র বিবেচনা করিত।
তিন
কোরেল গ্রামে প্রতি বৎসর অতি সমারোহের সহিত ঘোড়দৌড় হইত। আজি সেই উপলক্ষে প্রান্তস্থিত মাঠে বহু জনসমাগম হইয়াছিল।
মেরি ধীরে ধীরে লিওর পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল। লিও তখনও অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পুস্তক লিখিতেছিল, তাই দেখিতে পাইল না। মেরি কহিল, ‘আমি আসিয়াছি, ফিরিয়া দেখ।’
লিও ফিরিয়া দেখিয়া কহিল, ‘ইস—এত সাজিয়াছ কেন?’
মেরিও হাসিয়া ফেলিল; কহিল, ‘সাজিয়াছি কেন শুনিবে?’
‘বল।’
আজ ঘোড়দৌড় হইবে। যে জয়ী হইবে, সে আজ আমাকেই ফুলের মালা দিবে।’
তবে ত তোমার আজ বড় সম্মান! তাই এত সাজসজ্জা!’
মেরি প্রীতি-প্রফুল্ল নেত্রে কিছুক্ষণ লিওর মুখপানে চাহিয়া রহিল, তাহার পর পরম স্নেহে দুই হস্তে তাহার গ্রীবা বেষ্টন করিয়া মুখের কাছে মুখ রাখিয়া বলিল, ‘শুধু তাই নয়। তুমি আমার কাছে থাকিবে। তোমার পাশে দাঁড়াইয়া পাছে নিতান্ত কুৎসিত দেখিতে হই, সেই ভয়ে এত সাজিয়াছি,—মণিমুক্তায় রূপ বাড়ে ত?’
সম্মুখস্থিত মুকুরে দুটি মুখ ততক্ষণ দুটি পরিস্ফুট গোলাপ ফুলের মত ফুটিয়া উঠিয়াছিল, লিও তাহা দেখাইয়া বলিল, ‘ঐ দেখ।’
মেরি অতৃপ্ত নয়নে কিছুক্ষণ ঐ দুটি ছবির পানে চাহিয়া রহিল। তাহার বোধ হইল সেও বড় সুন্দরী। আজ তাহার প্রথম মনে হইল সৌন্দর্যের আশ্রয়ে দাঁড়াইলে কুৎসিত দেখিতে হয় না, বরং যাহা সৎ তাহাকে জড়াইয়া থাকিলে দোষটুকুও চাপা পড়িয়া যায়।আবেশে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মেরি ধীরে ধীরে কহিল, ‘আমি যেন চাঁদের কলঙ্ক—তবু আমার কত শোভা!’
মেরি শিহরিয়া উঠিল।লিও তাহা অনুভব করিল, তাই তাহার মুখখানি আরও কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘চাহিয়া দেখ,—তুমি আমার কলঙ্ক নহ—তুমি আমার শোভা! তুমি চাঁদের পূর্ণবিকশিত, উজ্জ্বল কৌমুদী!’
চক্ষু চাহিতে মেরির কিন্তু সাহস হইল না। কতক্ষণ হয়ত এইভাবে কাটিত, কিন্তু এই সময় অদূরস্থিত গির্জার ঘড়িতে ঢং করিয়া একটা বাজিল। মেরি চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, ‘সময় হইয়াছে—চল!’
‘আমার যাওয়া একেবারে অসম্ভব।’
‘কেন?’
‘এই পুস্তক পাঁচ দিনের মধ্যে শেষ করিয়া পাঠাইব বলিয়া চুক্তি করিয়াছি,—চুক্তিভঙ্গ হইলে বড় লজ্জায় পড়িব।’