কেশব বলিলেন, ‘আরো অনেক পাখির গলা চিকচিক করে মা, সেইজন্যই হয় না।’
কমলা কিছুক্ষণ স্থির হইয়া চিন্তা করিয়া অবিশ্বাসের স্বরে বলিল, ‘তা করুক জ্যাঠামশাই, কিন্তু, তারা ডাকবার সময় অমন ন্যাজ নিচু করে না—এরা ন্যাজ নিচু করে।’
কেশব বলিলেন, ‘ফিঙে পাখিও ন্যাজ নিচু করে।’
‘করে? কিন্তু, তাও যদি করে, তারা ত ছাতে বসে বাড়ি চিনিয়ে দেয় না। আর তারা ডাকলে ভয় করে না, কিন্তু এরা ডাকলে যে ভয় করে! আচ্ছা, তোমার করে না?
কেশব এ অকাট্য যুক্তি আর খণ্ডন করিতে পারিলেন না। ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘করে বৈ কি মা, আমারও ভয় করে।’
কমলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘আমার বড্ড করে। আচ্ছা, জ্যাঠাইমা আমার ভাল হয়ে উঠচেন না কেন? একটা দাঁড়কাক কালও ডেকেচে। আজও একবার সকালে ডেকেচে—তাই, বৌদি বলছিলেন’—বলিয়াই সে সহসা থামিয়া গেল। এতক্ষণে কেশব বুঝিলেন, কেন কমলা দাঁড়কাকের বিরুদ্ধে নালিশ করিতে আসিয়াছে। তাঁহার স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রায় এক বৎসর হইতে পীড়িত হইয়া আছেন, কিছুতেই আরোগ্য হইতে পারিতেছিলেন না। বরং মাস-খানেক হইতে আরও যেন বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাল সমস্ত দিন শয্যাত্যাগ করিতেও পারেন নাই। ছয় বৎসর পূর্বে সিদ্ধেশ্বরীর ছোটছেলের মৃত্যু হয়। তখন হইতেই তাঁহার দেহ ধীরে ধীরে ভাঙ্গিতেছিল। এই পাঁচ বৎসর ভাল-মন্দে কোনমতে কাটাইয়া গত বৎসর হইতে রীতিমত পীড়িত হইয়া পড়িয়া ছিলেন। কেশব যথাসাধ্য চিকিৎসার ত্রুটি করেন নাই, কিন্তু ফল হয় নাই। তাই ইদানীং তাঁহার আশঙ্কা হইতেছিল, বুঝিবা, সত্যই তাঁহার পরকালের ডাক পড়িয়াছে। এখন কমলার কথায় তাঁহার চোখ-দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। কমলা তাহা লক্ষ্য করিয়াই তাঁহার জানুদ্বয়ের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। কেশব জামার হাতায় চোখ মুছিয়া ফেলিয়া ভারী গলায় আস্তে আস্তে বলিলেন,—‘কাঁদিস নে মা, ভাল হয়ে যাবে।’
কমলা মুখ না তুলিয়াই প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘তবে, কেন ওরা অমন করে বলে?’
‘কে কি বলে মা?’
কমলা তেমনি করিয়াই জবাব দিল, ‘মা আর বৌদি। তারা ফিসফিস করে কি বলছিল—আমি যেতেই চুপ করলে, আমাকে শুনতে দিলে না।’
কোরেল
এক
লন্ডন নগরের পঞ্চাশৎ মাইল উত্তরে কোরেল নামে একটি গ্রামে ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতীরস্থ দুইখানি অট্টালিকা গ্রামের শোভা শতগুণে বর্ধিত করিয়া রাখিয়াছিল। উভয়ের সৌন্দর্যে একটা সাদৃশ্য থাকিলেও একটি অপরটি অপেক্ষা এত বৃহৎ জমকাল এবং মূল্যবান যে, দেখিলে বোধ হয় যেন কোন রাজা তাঁহার যৌবনের প্রথমাবস্থায় একটি নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তাহার পর যত দিন গড়াইয়া পড়িতে লাগিল, সুখসম্পদ পরিব্যাপ্ত আত্মসুখ যেদিন মরণের ছায়াটা সম্মুখে ঈষৎ হেলাইয়া ধরিয়াছিল, সেই দিন হইতে বোধ হয় অপরটির নির্মাণকর্ম আরম্ভ করাইয়াছিলেন। তাহাই যৌবনে এবং বার্ধক্যে যেরূপ প্রভেদ, এই দুইটি অট্টালিকার মধ্যেও সেইরূপ একটা প্রভেদ লক্ষিত হইত। একটি তাঁহার বিলাসভবন, রাজসভা, অপরটা তাঁহার শান্তিনিকেতন, কুঞ্জকানন। একটিতে কত মর্মরপ্রস্তর, কারুকার্যশোভিত কত ঝরনা, রঞ্জিত পত্রপুষ্পগঠিত কুঞ্জবন,তাহার পর তোষাখানা, অশ্বশালা, পশ্বালয় গ্রামের মত চতুর্দিকে ঘেরিয়া আছে, আর ভিতরে কত আসবাব! কত টেবিল, চেয়ার, পিয়ানো প্রভৃতি বহুমূল্য কার্পেটের উপর দাঁড়াইয়া আছে- ভিত্তিসংলগ্ন বৃহৎ মুকুরে সে শোভা সহস্রবার প্রতিফলিত হইয়াছে,তাহার উপর কত রকমের চিত্র, নানাবিধ ঝাড়-লণ্ঠন দেয়ালগিরির মধ্য দিয়া স্ব স্ব সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু অপরটিতে অত কিছু নাই। বাইরে শুধু শ্যামল তৃণদল, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুষ্পতরু, লতাবিতান, একঝাড় পিয়ার বৃক্ষ, একদল আঙ্গুরের কুঞ্জবন মধ্যে দুই একটি বসিবার বেঞ্চ; নদীর ধারে দুই ঝাড় বংশবাটিকা, তন্মধ্যে এই ক্ষুদ্র অট্টালিকাখানি
নদীতীর হইতে ঈষৎ দেখা যায় মাত্র!
দুইজন প্রাচীন সৈনিক এই দুই ভবনের অধিকারী। একজনের নাম ক্যাপ্টান নোল; অপরের নাম কর্নেল হ্যারিংটন। যুদ্ধকর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া দুই বন্ধু নির্জনে এই দুটি অট্টালিকা সামর্থ্য অনুসারে ক্রয় করিয়া বাস করিতেছিলেন। Captain Noll- এরও একটি মাত্র কন্যা-নাম মেরি; Colonel Herrington-এরও একটি মাত্র পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহার নাম লিওপোল্ড-জননী আদর করিয়া লিও বলিয়া ডাকিতেন।
একদিন লিওর জননী পুত্রকে শিয়রে বসাইয়া মেরিকে আশীর্বাদ করিয়া স্বামীর কর নিজ করে গ্রহণ করিয়া বসন্তপ্রভাতে সূর্যোদয়ের সহিত হাসিমুখে চিরদিনের মত প্রস্থান করিলেন। লিওর তখন দশ বর্ষ মাত্র বয়ঃক্রম;—খুব কাঁদিতে লাগিল। মেরির জননী আসিয়া তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন, মুখ চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘ভয় কি বাবা, আমি চিরদিন তোমার মা হইয়া থাকিব।’ সপ্তবর্ষীয়া বালিকা মেরি লিওর হাতে ধরিয়া বলিল, ‘লিও কাঁদিও না—চুপ কর।’ লিও চুপ করিল।
স্ত্রীবিয়োগের পর কর্নেল হ্যারিংটন জুয়াক্রীড়ায় নিতান্ত মনঃসংযোগ করিলেন। সঞ্চিত অর্থ যত সঙ্কুচিত হইয়া আসিতে লাগিল, প্রবাসী পুত্রমুখ স্মরণ করিয়া তত অধিক উৎসাহের সহিত নষ্ট ধন পুনঃপ্রাপ্তির আশায় জুয়াক্রীড়া করিতে লাগিলেন। ক্রমে সমস্ত নিঃশেষ হইয়া আসিল, ক্রীড়ার মত্ততায় তিনি আত্মবিস্মৃত হইয়া বন্ধু নোলের নিকট বাটী বন্ধক রাখিয়া ঋণ গ্রহণ করিলেন! তাহাও শেষ হইল—দারুণ নিরাশায় তাঁহার উন্মত্ততা আসিল, একদিন রাত্রে খাইবার সংস্থান পর্যন্ত নাই—আর সহ্য হইল না—বন্দুকে গুলি ভরিয়া আত্মহত্যা করিলেন। পুত্র লিও তখন লন্ডনে বিদ্যাভ্যাস করিতেছিল—সংবাদ পাইয়া বাটী আসিল। মেরির জননী তখন জীবিত নাই। ক্যাপ্টান নোল মৌখিক সান্ত্বনা মাত্র করিলেন। সপ্তদশ বর্ষীয় লিও অকূলসমুদ্র দেখিয়া যখন ছটফট করিতেছিল, নিরতিশয় মমতায় করুণ অশ্রুভারাক্রান্ত চক্ষু দুটি লিওর মুখের পানে রাখিয়া তাহার হাত ধরিয়া মেরি কহিল, ‘লিও ভয় করিও না—তোমার মেরি এখনও মরে নাই।’