একবার বলিয়াছি, ভাষা ছাড়া চিন্তা করা যায় না। তাই জগতে যাঁহারা চিন্তাশীল বলিয়া খ্যাত,তা সে চিন্তার যে-কোন দিকই হউক, মাতৃভাষায় দেশের সাহিত্যে তাঁহারা ব্যুৎপন্ন এ কথা বোধ করি অসংশয়ে বলা যায়।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের প্রতি চোখ ফিরাইলে এই সত্য অতি সহজেই সপ্রমাণ হয়। তাঁহারা দর্শন বা বিজ্ঞান লইয়াই থাকেন, লোকে তাঁহাদের চিন্তার ঐ দিকটার পরিচয় পায়, কিন্তু, দৈবাৎ কোন প্রকাশ পাইলে, বৈজ্ঞানিকের অসাধারণ সাহিত্য-ব্যুৎপত্তি দেখিয়া লোকে বিস্ময়ে অবাক হইয়া যায়। বিলাতের হক্সলি, টিন্ডল, লজ, ওয়ালেশ, হেল্ম হোজ, হেকেল প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকেরা খুব বড় সাহিত্যিক। আমাদের জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্রও কোন খ্যাত সাহিত্যিক অপেক্ষা ছোট নহেন।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় কিছুই থাকে না, যদি এই কথাটা মনে রাখা যায়। সাহিত্যকে বাদ দিয়া যাঁহারা বিজ্ঞান আলোচনা করেন, তাঁহারা বিজ্ঞানবিৎ হইলেও হইতে পারেন, কিন্তু বাহিরের সংসার তাঁহাদের পরিচয় পায় না। কারণ, ভাষা সাহিত্যকে অবহেলা করার সঙ্গে সঙ্গেই, স্বাধীন চিন্তাশক্তিও অন্তর্ধান করে।
এইবার সাহিত্যের দ্বিতীয় অংশের কথা আপনাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিব। কিন্তু তাহার পূর্বে এতক্ষণ যাহা বলিলাম তাহা কি? তাহা শুধু এই যে, মাতৃভাষা শিক্ষার যথেষ্ট আবশ্যকতা আছে। পরের ভাষায় সংসারের সাধারণ মামুলি কর্তব্যই করা যায়, কিন্তু বড় কাজ, বড় কর্তব্যের পথ মায়ের উঠানের উপর দিয়াই—তাহার আর কোন পথ নাই। ইতিহাস ও বিজ্ঞান এই সত্যই প্রচার করে।
কিন্তু সাহিত্য বলিতে সাধারণত কাব্য ও উপন্যাসই বুঝায়। সে যে নিছক কাল্পনিক বস্তু। একশ্রেণীর কাজের লোক আছেন, তাঁহাদের বিশ্বাস যাহা কল্পনা তাহাই মিথ্যা এবং মিথ্যা কোন দিন কাজে লাগিতে পারে না। সেটা পড়িয়া নিশ্চয়ই জানিয়া রাখা উচিত, বিলাতের রাজা অত নম্বরের হেনরীর কতগুলি ভার্যা ছিল এবং অমুক অমুক সালে, তাহাদের অমুক অমুক কারণে, অমুক অমুক দশা ঘটিয়াছিল। কারণ, কথাগুলি সত্য কথা এবং দশাগুলি সত্যই ঘটিয়াছিল। কিন্তু, কি হইবে জানিয়া বিষবৃক্ষের নগেন্দ্রনাথের ভার্যা সূর্যমুখীর কি দশা ঘটিয়াছিল এবং কেন ঘটিয়াছিল? তাহা ত সত্যই ঘটে নাই—লেখক বানাইয়া বলিয়াছেন মাত্র। বানানো কথা পড়িয়া বড় জোর সময়টাই কাটিতে পারে। কিন্তু, আর কোন্ কাজ হইবে? তাঁহাদের মতে যাহা ঘটিয়াছে তাহাই সত্য, কিন্তু যাহা হয়ত ঘটিলে ঘটিতে পারিত কিন্তু ঘটে নাই, তাহা মিথ্যা। কিন্তু বস্তুতঃ তাই কি? এইখানে কবির অমর উক্তি উদ্ধৃত করি—
ঘটে যা তা সব সত্য নয়, কবি তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
বস্তুতঃ ইহাই সত্য এবং বড়রকমের সত্য। ইংরাজেরা যাহাকে ‘এ হায়ার কাইন্ড অফ ট্রুথ’ বলেন, ইহা তাহাই। সীতাদেবী যথার্থই শ্রীরামচন্দ্রকে অতখানি ভাল বাসিয়াছিলেন কিনা, ঠিক অমনি পতিগতপ্রাণা ছিলেন কিনা, যথার্থই রাজপ্রাসাদ, রাজভোগ ত্যাগ করিয়া বনে-জঙ্গলে স্বামীকে অনুসরণ করিয়াছিলেন কিনা, কিংবা ঐতিহাসিক প্রমাণে তাঁহাদের বাস্তব সত্তা কিছু ছিল কিনা, ইহাও তত বড় সত্য নয়, যত বড় সত্য কবির মনোভূমিতে জন্মিয়া রামায়ণের শ্লোকের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
জানকী দেবী হউন, মানবী হউন, সত্য হউন, রূপক হউন, যাহা ইচ্ছা হউন; অত গভীর পতিপ্রেম তাঁহাতে সম্ভব-অসম্ভব যাহাই হউক, কিছুমাত্র আসে যায় না; যখন, ঐ গভীর দাম্পত্য-প্রেমের ছবি কবির হৃদয়ে সত্য বলিয়া প্রতিভাত হইতে পারিয়াছে এবং যুগ-যুগান্তর নর-নারীকে আদর্শ দাম্পত্য প্রেমে দীক্ষা দিয়া আসিয়াছে, ইহাই সত্য। সত্যকার অযোধ্যা সত্যকার রাম-সীতা অপেক্ষা সহস্র সহস্র গুণে সত্য। অযোধ্যা হয়ত একটি রাম, একটি সীতাতে সত্য, কিন্তু কবির কল্পনায় যে রাম-সীতা জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, হয়ত তাহা আজ পর্যন্ত কোটি কোটি রাম-সীতাতে সত্য হইয়াছে।
সেদিন স্নেহলতার আত্মবিসর্জনকাহিনী সংবাদপত্রে পড়িয়াই মনে হইয়াছিল ঠিক এমনি করুণ, এমনি স্বার্থত্যাগের চিত্র কিছুদিন পূর্বে গল্প-সাহিত্যে পড়িয়াছিলাম। সে মেয়েটিও দরিদ্র পিতাকে দুঃখ-কষ্ট হইতে অব্যাহতি দিবার জন্যই আত্মবিসর্জন করিয়াছিল। তাহারও বিবাহের বয়স উত্তীর্ণ হইতেছিল এবং পাত্র পাওয়া যাইতেছিল না।
সংবাদপত্রের কাহিনী ঐ একটি স্নেহলতাতেই সত্য, কিন্তু কবির কল্পনায় যে মেয়েটি আত্মহত্যা করিয়াছিল, তাহা হয়ত শত-সহস্রে সত্য।
স্নেহলতা শিক্ষিতা ছিলেন, কে জানে তিনি এই কাহিনী পড়িয়াছিলেন কি না, এবং স্বার্থত্যাগ-মন্ত্র ইহাতেই পাইয়াছিলেন কি না!
আমার বিশ্বাস কিন্তু এই। আমার নিশ্চয় মনে হয়, তিনি লেখাপড়া না জানিলে, সাহিত্যচর্চা না করিয়া থাকিলে কিছুতেই এ শক্তি, এ বল নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইতেন না। কবির কল্পনা এমনি করিয়াই সত্য হয়, কবির কল্পনা এমনি করিয়াই কাজ করে।
দেশের কল্পনায় দেশের সাহিত্য, দেশের ইতিহাস বড় হউক, জীবন্ত হউক, সত্য হউক, সুন্দর হউক, এই প্রার্থনাই আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করিতেছি। প্রত্যেক সুসন্তান অকপটে মাতৃভাষার সেবা করুন, এইটুকু মাত্র ভিক্ষা আপনাদের কাছে সবিনয়ে করিতেছি। কিন্তু কি করিলে সাহিত্য ঠিক অমনটি হইবে, সে পরামর্শ দিবার স্পর্ধা আমার নাই। শুধু এইটুকু মাত্র বলিতে পারি, যাহা সত্য বলিয়া মনে হইবে, অন্তরের সহিত যাহাকে সুন্দর বলিয়া বুঝিবেন, নিজের সাধ্যমত সেই পথ ধরিয়াই চলিবেন—তার পরে ফল ভবিষ্যতের হাতে।