গোবিন্দ বসিয়া সমস্তটা শুনিলেন, কিন্তু একটি কথাও না কহিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন।
তাহার পর হইতে সুরমা না খাইয়া, না শুইয়া কাঁদিয়া কাটিয়া মাথা খুঁড়িয়া কি কাণ্ডই না করিয়া বেড়াইল। কিন্তু, মরণের দিনটিতে এমনি আশ্চর্য শান্ত হইয়া গেল যে, পাড়ার লোকেরা পর্যন্ত বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। মা-কে দেখিতে দুই মেয়ে এবং জামাইরা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। সকলের সুমুখে তিনি সুরমাকে স্বামীর হাতে-হাতে সঁপিয়া দিয়া বলিলেন, এটি আমার সকলের ছোট সন্তান। এর যেন কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অযত্ন না হয়। আর আমার গায়ের সমস্ত গহনা একে দিয়ে গেলুম।
তাঁহার অনেক টাকার অনেক রকমের অলঙ্কার ছিল—সুতরাং পুত্রবধূ এবং মেয়েরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইল।
বহুদিন হইতে ভুগিয়া ভুগিয়া তিনি একটু একটু করিয়া মরিতে ছিলেন, সেই জন্য শেষ সময়টিতেও জ্ঞান ছিল, সুরমাকে বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া কানে কানে বলিলেন, সুরো, তোর বুড়ো জ্যাঠামশাইকে দেখিস মা,—তুই ছাড়া ওঁর আর কেউ রইল না। ওঁকে তোর ভরসায় রেখেই আমি নির্ভাবনায় যাচ্ছি।
মেয়েরা এই কানে কানে কথাটা শুনিতে না পাইয়া মনে মনে আরও ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়া অনুমান করিল, তিনি নিশ্চয়ই গোপনে তাঁহার সঞ্চিত টাকাকড়ির সন্ধান বলিয়া দিয়া গেলেন।
জ্যাঠাইমা পরলোকে চলিয়া গেলেন। শুধু সেই দিনটি মাত্র সুরমা হতজ্ঞানের মত স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়া রহিল। কেমন করিয়া সেদিন সে রাত্রি কাটিল, তাহা সে ঠাহর পাইল না। কিন্তু পরদিন আপনা-আপনিই সুস্থির সুদৃঢ় হইয়া উঠিয়া বসিল। তাহার চোখে-মুখে বিহ্বলতার লেশমাত্র রহিল না। প্রচণ্ড ভূমিকম্প যেমন মুহূর্তের আলোড়নে সমুদ্রতলদেশকে পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া যায়, জ্যাঠাইমার মৃত্যু তেমনি এই একটি দিনের নিদারুণ ধাক্কায় বালিকা সুরমাকে একেবারে প্রবীণতার সীমায় পৌঁছাইয়া দিয়া দু-দিনের আড়ালে পড়িয়া গেল।
শোকাচ্ছন্ন গোবিন্দ মুখুয্যে ঘাড় গুঁজিয়া বাহিরের ঘরে বসিয়া ছিলেন, সুরমা নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া তাঁহার কেশবিরল মাথাটিতে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে প্রশ্ন করিল, জ্যাঠামশাই?
কেন মা?
জ্যাঠাইমা এতক্ষণ আমার মায়ের সঙ্গে বসে কত গল্প কচ্চেন না?
গোবিন্দ হঠাৎ প্রশ্নটা বুঝিতে না পারিয়া মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।
সুরমা কহিল, জ্যাঠাইমা বলতেন, সবাই স্বর্গে গেলে আবার দেখা হয়। আচ্ছা, আমার ত মাকে মনে পড়ে না, আমি কেমন করে চিনে নেব?
গোবিন্দ আগ্রহভরে উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ সুরমা, তোর জ্যাঠাইমা বুঝি এই সব বলতেন? আচ্ছা, তোদের দুজনের কি কি কথা হত আমাকে সব খুলে বল ত মা।
তখন সুরমা একটি একটি করিয়া স্মরণ করিয়া বলিতে লাগিল। তিনি সুদীর্ঘ রোগশয্যায় শুইয়া জীবনের আশা ত্যাগ করিয়া কতদিন কত উপলক্ষে কত কথাই না এই মেয়েটিকে বলিয়াছিলেন। মরণের পর সুস্থ সবল দেহের কথা, পুনরায় দেখা-সাক্ষাতের কথা।
হাঁরে সুরো?
কেশব লাহিড়ী মাইনার ইস্কুলের হেডমাস্টার, বেতন ত্রিশ টাকা। এই গ্রামখানিতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সদরওয়ালা, বড় চাকুরে, জমিদার প্রভৃতি অনেক বড়লোকের বাস, তথাপি লাহিড়ীমশায়ের ন্যায় সম্মানিত ব্যক্তি বোধ করি আর কেহই ছিলেন না। এ সম্মান তাঁহার নিজের অর্জিত এবং একেবারে নিজস্ব। সেই জন্যই মনে হয় ছোট, বড়, ইতর, ভদ্র সবাই মান্য করিয়া চলিত।
আজ রবিবার, স্কুল ছিল না। অপরাহ্ণবেলায় তিনি বাহিরের উঠানে চাঁপাতলায় একখানি চৌকি পাতিয়া নিবিষ্টচিত্তে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পাঠ করিতেছিলেন। চোখের কোণ বাহিয়া জল ঝরিয়া পড়িয়াছিল, তাহাই মুছিবার জন্য ক্ষণকালের নিমিত্ত চশমাখানি নামাইয়া ধরিয়া চোখ মুছিতেছিলেন, হঠাৎ পিছন হইতে ডাক আসিল, ‘জ্যাঠামশাই?’
‘কেন মা?’
কমলা তাঁহার বড় আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী, বয়স দশ বৎসর। কাছে আসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘আচ্ছা, জ্যাঠামশাই, সাহেবরা ত এত পারে, তবে কেন দাঁড়কাকগুলোকে সব মেরে ফেলে না?’ কমলার অদ্ভুত প্রশ্নে কেশব হাসিলেন। বলিলেন, ‘সে খবর ত জানিনে মা। কিন্তু দাঁড়কাকগুলোর অপরাধ?’
কমলা অতিশয় গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘বাঃ,—ওরা যে যমের বাহন, জ্যাঠামশাই। চিলেরা ছাতে বসে ডেকে ডেকে বাড়ি চিনিয়ে দেয়, তাই ত যমের দূত চিনতে পারে। নইলে কেউ ত মরত না, সবাই কেমন মজা করে বেঁচে থাকত, না জ্যাঠামশাই?’
কেশব হাসিতে লাগিলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ খবরটি কে তোমাকে দিলে মা?’
‘বউদি। সত্যি, না?’
কেশব মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ তোমার বউদির কথা হয়ত সত্যি নয় মা।’
কমলা আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, ‘সত্যি নয়?’ পরক্ষণেই একগোছা চুল কপালের একাংশ হইতে সরাইয়া দিয়া বার-দুই গ্রীবা আন্দোলিত করিয়া বলিল, ‘না জ্যাঠামশাই, সত্যি। নইলে ওরা ত দাঁড়কাক, তবে কেন ওদের ময়ূরের মত গলা চিকচিক করে?’
কেশব প্রথমে উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিলেন, তারপর যথাসাধ্য গম্ভীর হইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু মা, তোমার কালো পায়রাগুলোরও ত গলা চিকচিক করে।’
কমলা বলিল, ‘তা করলেই বা। তারা যে পায়রা, লক্ষ্মীর বাহন, আর এরা যে দাঁড়কাক।’
কেশব ক্ষণকাল হাসিমুখে নিরুত্তর থাকিয়া বলিলেন, ‘তবুও, আমার বিশ্বাস হয় না মা।’
কমলা ক্ষুণ্ণ হইল। মুখখানি অপ্রসন্ন করিয়া সেইখানে হাঁটু গড়িয়া বসিয়া জ্যাঠামশায়ের জানুর উপর হাতের ভর দিয়া মুখ তুলিয়া বলিল, ‘কেন বিশ্বাস হয় না তোমার?’