এই জন্য ভাবের ক্রমিক বিকাশ, বয়োবৃদ্ধি ও ধারণা-শক্তির বিকাশের উপর নির্ভর করে। এবং তাহার উপর ভাব ও চিন্তার সংখ্যাবৃদ্ধি হয়।
কিন্তু চিন্তা-পদ্ধতির সর্বাপেক্ষা সাধারণ নিয়ম এই যে, পুরাতন ভাব ও ধারণার ভিত্তি অবলম্বন না করিয়া প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত চিন্তাস্রোতে গা ভাসান না দিয়া মানব-চিত্ত কোনমতেই নতুন ধারণা বা নূতন ভাব আয়ত্ত করিতে পারে না। জ্ঞাত ও সুনির্দিষ্ট পদার্থ নিয়ে অতীত দিনে যেভাবে চিত্তকে নাড়া দিয়া তাহার গুণ ও ধর্মের কাহিনী জানাইয়া দিয়া গিয়াছে, অর্থাৎ তাহার সম্বন্ধে মনের মধ্যে যে জ্ঞান জন্মিয়া রহিয়াছে, সেই জ্ঞানের সহিত তুলনা না করিয়া, তাহাদিগকে ব্যবহার না করিয়া কোনমতেই মানুষ পদার্থের নূতন লক্ষণ ও ধর্মের পরিচয় পাইতে পারে না।
যেমন করিয়া এবং যে-যে উপায়ে শিশুচিত্তে প্রথম চৈতন্যের বিকাশ ঘটিয়াছিল জানিয়া এবং না জানিয়া যে-সকল পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া সেই তরুণ চিত্ত, ভাব, চিন্তা ও ধারণায় অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, যে-সমস্ত জল, হাওয়া ও আলোক পাইয়া তাহার জ্ঞানের অঙ্কুর পল্লবিত হইয়া আজ শাখা-প্রশাখায় বড় হইয়াছে, সে জল, হাওয়া, আলোককে বাদ দিয়া আর একটা অভিনব প্রণালীতে মানবচিত্ত কোনমতেই নূতন জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। অর্থাৎ যেমন করিয়া সে মাতৃক্রোড়ে বসিয়া চিন্তা করিতে শিখিয়াছিল মরিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে সে-পথ ছাড়িয়া যাইতে পারে না—পুরাতন জ্ঞানকে অস্বীকার করিয়া পুরাতন পদ্ধতি ত্যাগ করিয়া কাহারোই নূতন জ্ঞান, নূতন চিন্তা জন্মে না।
আরো একটা কথা। ভাব ও চিন্তা যেমন ভাষার জন্মদান করে, ভাষাও তেমনি চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত, সুসম্বন্ধ ও শৃঙ্খলিত করে। ভাষা ভিন্ন ভাবা যায় না। একটুখানি অনুধাবন করিলেই দেখিতে পাওয়া যায়, যে-কোন একটা ভাষা মনে মনে আবৃত্তি করিয়াই চিন্তা করে—যেখানে ভাষা নাই, সেখানে চিন্তাও নাই।
আবার এইমাত্র বলিয়াছি, পুরাতন নিয়মকে উপেক্ষা করিয়া, পুরাতনের উপর পা না ফেলিয়া নূতনে যাওয়া যায় না—আবার ভাষা ছাড়া সুসম্বন্ধ চিন্তাও হয় না—তাহা হইলে এই দাঁড়ায় বাঙ্গালী বাংলা ছাড়া চিন্তা করিতে পারে না, ইংরাজ ইংরাজি ছাড়া ভাবিতে পারে না। তাহার পক্ষে মাতৃভাষা ভিন্ন যথার্থ চিন্তা যেমন অসম্ভব, বাঙ্গালীর পক্ষেও তেমনি। তা তিনি যত বড় ইংরাজি-জানা মানুষই হউন। বাংলা ভাষা ছাড়া স্বাধীন, মৌলিক বড় চিন্তা কোনমতেই সম্ভব হইবে না।
এ-সব বিজ্ঞানের প্রমাণিত তথ্য। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না। চলে শুধু গায়ের জোরে, আর কিছুতে না।
যে ভাষায় প্রথম মা বলিতে শিখিয়াছি, যে ভাষা দিয়া প্রথম এটা ওটা সেটা চিনিয়াছি, যে ভাষায় প্রথমে ‘কেন’ প্রশ্ন করিতে শিখিয়াছি, সেই ভাষার সাহায্য ভিন্ন ভাবুক, চিন্তাশীল কর্মী হইবার আশা করা আর পাগলামি করা এক। তাই যে কথা পূর্বে বলিয়াছি তাহারি পুনরাবৃত্তি করিয়া বলিতেছি, পরভাষায় যত বড় দখলই থাক, তাহাতে ঐ চলা-বলা-খাওয়া, নিমন্ত্রণ রক্ষা, টাকা রোজগার পর্যন্তই হয়, এর বেশি হয় না, হইতে পারে না।
তারপরে সাহিত্য। আমার মনে হয়, সর্বত্র এবং সকল সময়েই ভাষা ও সাহিত্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে গ্রথিত। যেন পদার্থ ও তাহার ছায়া। অবশ্য প্রমাণ করিতে পারি না যে, পশুদের ভাষা আছে বলিয়া সাহিত্যও আছে। যাঁহারা ‘নাই’ বলেন, তাঁহাদের অস্বীকার খণ্ডন করিবার যুক্তি আমার নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না যে, ভাষা আছে কিন্তু সাহিত্য নাই।
ভাষা-বিজ্ঞানবিদেরা বলেন, মানবের কোন্ অবস্থায় তাহার প্রথম সাহিত্য-সৃষ্টি তাহা বলিবার জো নাই, খুব সম্ভব, যেদিন হইতে তাহার ভাষা, সেই দিন হইতে তাহার সাহিত্য। যেদিন হইতে সে তাহার হত দলপতির বীরত্ব-কাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিয়াছিল, যেদিন হইতে প্রণয়ীর মন পাইবার অভিপ্রায়ে সে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছিল, সেই দিন হইতেই তাহার সাহিত্য।
তাই যদি হয়, কে জোর করিয়া বলিতে পারে পশু-পক্ষীর ভাষা আছে অথচ সাহিত্য নাই? আমি নিজে অনেক রকমের পাখি পুষিয়াছি, অনেক বার দেখিয়াছি তাহারা প্রয়োজনের বেশি কথা কহে, গান গাহে। সে কথা, সে গান আর একটা পাখি মন দিয়া শুনে। আমার অনেক সময় মনে হইয়াছে, উভয়েই এমন করিয়া তৃপ্তির আস্বাদ উপভোগ করে, যাহা ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির অতিরিক্ত আর কিছু। তখন, কেমন করিয়া নিঃসংশয়ে বলিতে পারি ইহাদের ভাষা আছে, গান আছে কিন্তু সাহিত্য নাই? কথাটা হয়ত হাসির উদ্রেক করিতে পারে, পশু-পক্ষীর সাহিত্য! কিন্তু সেদিন পর্যন্ত কে ভাবিতে পারিয়াছিল গাছপালা সুখদুঃখ অনুভব করে? শুধু তাই নয়, সেটা প্রকাশও করে। তেমনি হয়ত, আমার কল্পনাটাও একদিন প্রমাণ হইয়া যাইতেও পারে।
যাক ও কথা। আমার বলিবার বিষয় শুধু এই যে, ভাষা থাকিলেই সাহিত্য থাকা সম্ভব; তা সে যাহারই হোক এবং যেখানেই হোক। অনুভূতির পরিণতি যেমন ভাব ও চিন্তা, ভাষার পরিণতিও তেমনি সাহিত্য। ভাব প্রকাশ করিবার উপায় যেমন ভাষা, চিন্তা প্রকাশ করিবার উপায়ও তেমনি সাহিত্য। জাতির সাহিত্যই শুধু জানাইয়া দিতে সক্ষম সে জাতির চিন্তাধারা কোন্ দিকে কোথায় এবং কতদূরে গিয়া পৌঁছিয়াছে। দর্শন, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, এমন কি যুদ্ধবিদ্যার জ্ঞান ও চিন্তাও দেশের সাহিত্যই প্রকাশ করে।