একটা কথা আমার অত্যন্ত দুঃখের সহিত মনে পড়িতেছে, আমার জীবনের আমি এমন দুই-একটা কৃতবিদ্য বাঙালীকে ঘনিষ্ঠভাবে জানিয়াছি, যাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পরীক্ষাগুলাই কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হইয়াও মাতৃভাষা জানা এবং না-জানার মধ্যে কোন পার্থক্যই দেখিতে পাইতেন না। তাঁহারা সব-কটাই পাস করিয়াছেন এবং সরকারী চাকরিতে হাজার টাকা বেতন পাইতেছেন। অর্থাৎ যে-সব অদ্ভুত কাণ্ড করিতে পারিলে বাঙালী সমাজে মানুষ প্রাতঃস্মরণীয় হয়, তাঁহারা সেই-সব করিয়াছেন। অথচ, বাঙ্গালায় একখানা চিঠি পর্যন্ত লিখিতে পারিতেন না। অবশ্য, না শিখিলে কিছুই পারা যায় না—ইহাতেও অত দুঃখের কথা নাই, কিন্তু বড় দুঃখের কথা এই যে, তাঁহারা নিজেদের এই অক্ষমতাটা বন্ধু-বান্ধবের কাছে আহ্লাদ করিয়া বলিতে ভালবাসিতেন। লজ্জার পরিবর্তে শ্লাঘাবোধ করিতেন অর্থাৎ ভাবটা এই যে, এত ইংরাজি শিখিয়াছি যে, বাঙ্গালায় একখানা চিঠি লিখিবার বিদ্যাটুকু পর্যন্ত আয়ত্ত করিবার সময় পাই নাই। জানি না, এ-রকম হাজার টাকার বাঙালী আরো কত আছেন, কিন্তু এটা যদি তাঁহারা জানিতেন যে, মাতৃভাষা না শিখিয়াও ঐ অতটা পর্যন্তই পারা যায়, কিন্তু তার ঊর্ধ্বে যাওয়া যায় না, ঐ চলা-বলা-খাওয়া-টাকা রোজগার পর্যন্তই হয়, আর হয় না; যথার্থ বড় কাজ, যা করিলে মানুষ অমর হয়, যাঁর মৃত্যুতে দেশে হাহাকার উঠে, তেমন বড় কর্মী কিছুতেই হওয়া যায় না, তাহা হইলে নিজেদের ঐ অক্ষমতার পরিচয় দিবার সময় অমন করিয়া হাসিয়া আকুল হইতে পারিতেন না।
তাই আজ আমি এই কথাটাই আপনাদিগকে বিশেষ করিয়া স্মরণ করাইতে চাই, যে, যথার্থ স্বাধীন ও মৌলিক চিন্তার সাক্ষাৎ মাতৃভাষা ভিন্ন ঘটে না, যথার্থ বড় চিন্তার ফল সংগ্রহ করিবার পথ মাতৃগৃহদ্বারের ভিতর দিয়াই, বাঙ্গালী যখন বাঙ্গালী, সে যখন সাহেব নয়, তখন, বিলাতি ভাষার মস্তবড় ফাটকের সম্মুখে যুগযুগান্তর দাঁড়াইয়াও কোনদিনই সে পথের সন্ধান পাইবে না।
এ কথা শুধু ইতিহাসের দিক দিয়াই সত্য নহে, মনোবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানের দিক দিয়াও সত্য।
কেন যে আজ পর্যন্ত জগতে, মানুষ যত-কিছু বড় চিন্তা করিয়া গিয়াছেন সে সমস্তই মাতৃভাষায়, বৈষয়িক উন্নতির অবনতির ফলে এক-একটা ভাষা সাময়িক প্রাধান্য এবং ব্যাপকতা লাভ করা সত্ত্বেও এবং সেই ভাষা সর্বতোভাবে আয়ত্তাধীন থাকা সত্ত্বেও কেন যে চিন্তাশীল ভাবুকেরা নামের লোভ ত্যাগ করিয়া নিজেদের অমূল্য চিন্তারাশি মাতৃভাষাতেই লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, কেন মাতৃভাষা ভিন্ন অপরের ভাষায় বড় চিন্তার অধিকার জন্মায় না, এই সত্যটা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিতে গেলে, প্রথমতঃ ভাষাবিজ্ঞানের দুটো মূল কথা মনে করিয়া লওয়া উচিত।
ব্রহ্মাণ্ডে আছে কি? আছে আমার চৈতন্য এবং তদ্বিষয়ীভূত যাবতীয় পদার্থ। অন্তর্জগৎ এবং বাহ্যজগৎ। উভয়ে কি সম্বন্ধ এবং সে সম্বন্ধ সত্য কিংবা অলীক, সে আলাদা কথা। কিন্তু এই যে পরিচয় গ্রহণ, একের উপরে অপরের কার্য, ইহাই মানবের ভাব এবং চিন্তা। এবং এই পদার্থ নিশ্চয়ই মানবের চিন্তার বিষয়। এমনি করিয়াই সমস্ত স্থূল বিশ্ব একে একে মানবের ভাব-রাজ্যের আয়ত্ত হইয়া পড়ে। ঘর-বাড়ি, সমাজ, দেশ প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ এক-একটি চিন্তার জন্মদান করিয়া ইহারাই মানব-চিত্তে এক-একটি ভাব উৎপন্ন করে। অন্তর্জগৎ ও বাহ্যজগৎ উভয়েই বিচিত্র তথ্য ও ঘটনায় ভরিয়া উঠে। উভয় জগতের এইসব তথ্য ও ঘটনা ছাড়া মানুষ ভাবিতেই পারে না। অর্থাৎ ইহাদের দ্বারাই মানবচিত্ত আন্দোলিত হইয়া ইহাতেই পরিপূর্ণ হইয়া যায়। এক কথায় ইহারা ভাব ও ধারণার কারণও বটে, ইহারা তাহার বিষয়ও বটে।
এইবার মনের মধ্যে পদার্থের পরীক্ষা হইতে থকে। ভাব ও চিন্তার কাছে তাহাদের প্রকৃতি ও স্বরূপ ধরা পড়ে, ধর্ম ও গুণের হিসাবে নানা লক্ষণবিশিষ্ট হইয়া বাহ্যজগৎ এইবার ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট হইতে থাকে।
মানবের ভাব ও চিন্তাই যাবতীয় পদার্থে গুণের আরোপ করে। সে কি, আর একটার সহিত তাহার কি প্রভেদ স্থির করিয়া দেয়। তারপর পদার্থের সহিত পদার্থের তুলনা করিয়া সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া লক্ষণ নির্ণয় করিয়া ধর্মবিশিষ্ট করিয়া আমরা তাহাদের ধারণা-কার্য সম্পূর্ণ করি।
বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন সময়ের মানব-চিন্তা-প্রণালী পর্যালোচনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায়, এই চিন্তা-প্রণালী কয়েকটা সাধারণ নিয়মের অন্তর্গত। একই নিয়মে মানবের চিন্তারাশি পরিপক্ক ও সম্পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।
যেমন বাহ্যজগতে দেখা যায়, কোন দুটি বস্তু একই সময়ে একই স্থান অধিকার করিতে পারে না অন্তর্জগতেও ঠিক তাই। সেখানেও কোন দুটি বস্তু এক সঙ্গেই চিত্ত অধিকার করিতে পারে না। সেই জন্যই আমরা কোনমতেই এক সঙ্গে একই আয়াসে দুটি বস্তুর পরিচয়-লাভ কিংবা একটি বস্তুর দুটি গুণনির্ণয় করিতে পারি না। আমরা বিষয় ভাগ করিয়া একটি একটি করিয়া লক্ষণ স্থির করি। অর্থাৎ চিন্তার কার্য ক্রমশঃ নিষ্পন্ন হয়। অন্তর্জগতে মন যেমন দুটি বস্তু বা দুটি গুণ এক সঙ্গে গ্রাহ্য করে না, বাহ্যজগতে পদার্থও তেমনি তাহার সব-কটা গুণই একই সময়ে মানব-চিত্তের কাছে প্রকাশ করে না। যুবতী রমণীর রূপ শিশুচিত্তের কাছে ধরা দেয় না। সে রূপের মূল্য উপলব্ধি করিবার জন্য শিশুচিত্তকে একটা নির্দিষ্ট বয়সের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হয়।