‘আমি যুদ্ধের চেয়ে সেতার বাজাইতে, চারণদের গান শুনিতে ভালবাসি। পিতৃ আজ্ঞায় যুদ্ধ করি।’
‘আর আমাদের ধর্ম বলিয়া যুদ্ধ করি, না?’
‘না, সমর (পুরুষবেশে যমুনার ইহাই নাম), মানুষ মারাটা ধর্ম বলিয়া মনে হয় না। তবে সকলই করিতে হয়।’
সমর সিংহ কহিল, ‘তোমার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, শুনিয়াছ?’
উ। শুনিয়াছি।
স। মরিতে তোমার ভয় হয় না?
উ। হয়, আমার মরিতে সাধ নাই।
সমর সিংহ কঠিন স্বরে কহিল, ‘তুমি রাজপুত। রাজপুত মরিতে ভয় পাইলে তাহার নরকে স্থান হয়, তুমি তবে কাপুরুষ?’
ভরত সিংহ কহিল, ‘তা বৈ কি!’ এবং কিঞ্চিৎ হাসিল।
‘তবে তোমাকে সকলে সাহসীর অগ্রণী বলে কেন?’
‘সকলেই কি সত্য বলে? তাহারা বোধ হয়—মিছা কথা কহে।’
‘মরিবার পূর্বে তোমার কি কিছু কামনা নাই?’
‘কত কামনা আছে। কিন্তু তাহাতে কাজ কি?’
‘মহারানীকে বলিয়া আমি তাহা পূর্ণ করাইয়া দিতে পারি।’
‘তাহা পার না। আপাততঃ আমার মাকে দেখিতে ইচ্ছা করে, তুমি দেখাইতে পার?’
যমুনা ভাবিয়া কহিল, ‘তোমার রানীমাতা এখানে আসিবেন কেন?’
‘তাই ত।’ রাজপুত্র পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া চক্ষু মুদিয়া রহিল।
পাঁচ
তার পরদিন সমর সিংহ রাজপুত্রকে ধরিয়া বসিল, ‘কাল তোমাদের বিচার, তুমি রানীর নিকট প্রাণভিক্ষা চাহিয়ো।’
রাজপুত্র হাসিয়া উঠিল, ‘তাই ত ভাই, ওরূপ ব্যবসা যে কখন করি নাই।’
—নাই করিলে, এখন প্রাণের জন্য সব করিতে হয়।
রাজপুত্র কথা কহিল না।
—বল, কাল ক্ষমা চাহিবে?
—বোধহয় পারিব না।
সমর সিংহ শিহরিয়া উঠিল, ‘তাহলে যে প্রাণ যাইবে।’
‘কি করিব ভাই! অন্য উপায় যে আর দেখিতেছি না।’
সমর সিংহ খুব কাছে আসিয়া বসিল। বলিল, ‘তোমার জননীর মুখ স্মরণ কর। তুমি তাঁহার একমাত্র পুত্র, তোমার মৃত্যুতে তাঁহারাও মরিবেন।’
পূর্বদিনের মত ভরত সিংহ পুনরায় পাশ ফিরিয়া শুইলেন। সমর সিংহ বসিয়া রহিল। রাত্রি বাড়িয়া যাইতেছে। প্রহরী বলিল, ‘এইবার যাইতে হইবে।’
সমর সিংহ ডাকিল—রাজপুত্র!
—কি ভাই!
—এই চারি-পাঁচদিন তোমার কত শুশ্রূষা করিয়াছি, অন্ততঃ আমার জন্য তুমি বাঁচিবার চেষ্টা কর।
‘আহা তোমার জন্য বড় দুঃখ হয়; কেন ভাই আমার এত করিতেছ?’
সমর সিংহ মুখ ফিরাইয়া কহিল—‘সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়ো না। বল তুমি বাঁচিবে?’
রাজপুত্র হাসিল। বলিল, ‘সে ত ভাই, তোমাদের রানীর হাত।’
সমর সিংহ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, ‘ভাই, তুমি একবার ক্ষমা চাহিলেই তিনি ক্ষমা করিবেন।’
‘আর যদি না চাই?’
সমর সিংহ মলিন হইয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘সে যে প্রাণের চেয়েও গর্ব ভালবাসে, তাই বড় ভয় হয়।’
প্রাতঃকালে মলিনা বলিল, ‘মহারানি! এস সাজাইয়া দিই। আজ যে রাজপুত্রের বিচার!’
মহারানী বড় বিরক্ত হইলেন। রক্ত-পদ্মের মত চক্ষু দুইটি ফিরাইয়া বলিলেন, ‘মহারানি মহারানি সর্বদা করিস কেন? যমুনা বলিতে পারিস না?’
সে বিস্মিত হইয়া ভাবিল, মহারানী বলিলে যে মুক্তার হার খুলিয়া দিতে পারে, সে আজ এমন করে কেন?
যমুনা বলিল, ‘আমি বিচার করিব না।’
‘তা কি হয়?’
—খুব হয়! বাবার সময় কি রাজত্ব চলিত না?
ছয়
বিচার সভা! স্বর্ণখচিত হীরক-মণিমুক্তাশোভিত, বিচিত্র পট্টবস্ত্রাবৃত স্বর্ণসিংহাসনে যমুনাবাই রাজরাজেশ্বরী বেশে বসিয়া আছে। মন্ত্রী, সভাপণ্ডিত, সভাসদ্, প্রভৃতি সারি দিয়া বসিয়া আছে। অসংখ্য প্রহরী রক্তবর্ণ সজ্জায় সুশোভিত হইয়া শান্তিরক্ষা করিতেছে।
‘জয় মহারানীর জয়! জয় মহারানীর জয়!’
শৃঙ্খলের ঝম ঝম শব্দ শ্রুত হইল। সকলেই চাহিয়া দেখিল, শৃঙ্খলাবদ্ধ শত শত বন্দী যোদ্ধার মধ্যে ভরত সিংহ দাঁড়াইয়া আছে।
কে একজন পার্শ্ব হইতে মৃদুস্বরে কহিল, ‘রাজপুত্র ক্ষমা চাহিও।’ পরিচিত স্বর।
রাজপুত্র চাহিয়া দেখিল, কিন্তু গোলমালের ভিতর সে লুকাইয়া পড়িল।
মহারানীর গলা কাঁপিয়া উঠিল, ‘রাজপুত্র।’
রাজপুত্র চাহিয়া দেখিল।
—কিছু কামনা আছে?
—কিছু না।
—তোমার আজ প্রাণদণ্ড হইবে।
রাজপুত্র কথা কহিল না, মনে হইল সমর সিংহ কোথায়!
—রাজপুত্র কিছু ভিক্ষা আছে?
রাজপুত্র মুখ তুলিল না। নত দৃষ্টিতে হাসিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল—না।
—কিছু না?
—না।
—তোমার মা—তোমার মনে কোন সাধ নাই?
—না।
মহারানী আদেশ করিলেন—রাজপুত্রকে বধ্যভূমিতে লইয়া যাও।
বিপ্রদাস-এর পরিত্যক্ত এক পৃষ্ঠা
মুখুয্যেমশাই, আমি সঙ্গে যাবো।
বিপ্রদাস সবিস্ময়ে কহিল, কোথায়? বলরামপুরে?
বন্দনা বলিল, নিয়ে যান ত রাজী আছি। কিন্তু এখন সে যাওয়ার কথা বলচি নে, বলচি দক্ষিণেশ্বরে যাবার, সাধুজীকে দেখবার ভারী ইচ্ছে হচ্ছে,—আর যদি আপত্তি না করেন ত মা-কালীকেও দর্শন করে আসবো।
কিন্তু তুমি ত এ-সব বিশ্বাস করো না।
না, করিনে, কিন্তু তাই বলে দেখবার ইচ্ছে হবে না কেন? সংসারে সবাই কি সব বিশ্বাস করে, তা বলে কি তারা চোখ বুজে থাকে?
বিপ্রদাস হাসিয়া কহিল, তবে চলো। কিন্তু এঁরা ফিরে এলে তাঁদের দেখবে কে? তুমি আমি দুজনেই চলে গেলে ত ঠিক হবে না।
বন্দনা বলিল, ঠিক হবে মুখুয্যেমশাই, কোন চিন্তা নেই, অন্নদাকে বলে সমস্ত বন্দোবস্ত করে আমি এখুনি আসচি। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল।
মিনিট-কয়েক পরে উভয়ে গাড়িতে বসিয়া বন্দনা বলিল, আমি শুনেচি আপনি ভারী পণ্ডিত। এদেশ-ওদেশ দু’দেশের সমস্ত বিদ্যেই আপনার আয়ত্ত। অত বড় লাইব্রেরির প্রত্যেক বইটি আপনার মুখস্ত।
এ সংবাদ দিলে কে? দিদি?