দিদি এসেছেন—
দিদি? কে বউমা?
পরক্ষণেই কমলা ঘরে ঢুকে গলায় আঁচল দিয়ে ভূমিতলে গড় হয়ে প্রণাম করতেই দুর্গামণি শশব্যস্ত হয়ে উঠ্লেন। দুধের বাটিটা মুখ থেকে নামিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন—থাক থাক, বউমা, আর পায়ের ধূলো নিতে হবে না। সারাদিন পরে দুধ ফোঁটাটুকু মুখে তুলেচি, এটুকু আর ছুঁয়ে দিয়ো না।
যে মেয়েটি খৈ বাচছিল সে স্পর্শ বাঁচিয়ে কুলোসমেত দু’হাত সামনে এগিয়ে গেল। কমলা নির্বাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু অরুণ যেন একেবারে অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলে উঠে বলে ফেল্লে—মিথ্যেবাদী! কেন তবে কাল তুমি বললে, ও-সব গুজবে তুমি বিশ্বাস করো না! কেন বললে—
শোন কথা! কবে আবার বললুম বিশ্বেস করিনে? আর জ্বরের ধমকে যদি কিছু বলেই থাকি ত সে কি আমার ধর্তব্যি, বাছা!
অরুণ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললে, তা হলে ত আমি কখখনো দিদিকে আনতুম না। দুর্গামণি দুধের বাটিটি সরিয়ে একটু নিরাপদ স্থানে রেখে বললেন, তা বেশ ত বাছা, অমন মারমুখী হোচ্চো কেন? সাণ্ডেল মশাই আসুন, রায় বট্ঠাকুরকে খবর দি,—ততক্ষণ ঘরে সবই আছে, পটলের মা বের কোরে দিক্—দোরের উনুনটায় বোক্নোয় করে ডাল-চাল দুটো ফুটিয়ে তোমাকেও দুটো দিক্, নিজেও দুটো খাক।
অরুণ চতুর্গুণ জ্বলে উঠে বললে, কি! আমরা তোমার বাড়ি ভিক্ষে নিতে এসেচি । এত বড় কথা বল তুমি! আচ্ছা, টের পাবে! এই বোলে সে কমলার হাতখানা চেপে ধরে বললে, চল দিদি, আমরা যাই,—এখনো আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে—এক মিনিটও এর মুখ দেখতে চাইনে।
কমলা ধীরে ধীরে নিজের হাতখানি মুক্ত করে নিয়ে বললে, চল, যাচ্চি ভাই। তারপরে মাথার আঁচলটা সরিয়ে দিয়ে শাশুড়ীর মুখের পানে চেয়ে শান্ত সহজ কণ্ঠে বললে, মা আমি চললুম, কিন্তু আমিও এ বাড়ির বউ, তোমারি মত এও আমার শ্বশুরের ভিটে। কিন্তু এমন অপরাধ আজও করিনি যাতে এ বাড়িতে আমাকে দোরের উনুনে রেঁধে খেতে হয়।
শাশুড়ী বললেন—তা কি জানি বাছা!
কমলার মলিন চোখের দৃষ্টি হঠাৎ শিখার মত দীপ্ত হয়ে উঠল—বোধ হয় কি যেন সে বলতেই চাইলে, কিন্তু সে অবসর আর পেলে না। অরুণ বজ্রমুষ্টিতে হাত ধরে জোর করে তাকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
বিচার
এক
রাঠোন রাজকুমারী যমুনাবাই ছেলেবেলায় তাহার পিতার ক্রোড়ে বসিয়া বলিত—‘বাবা, তুমি সিংহাসনে বসিয়া বিচার কর না কেন?’ অজয় সিংহ কন্যার শির চুম্বন করিয়া বলিতেন—‘মা, তোমার বুড়ো বাবার বড় ভুল হয়, তাই সে আর বিচার করে না—সিংহাসনে বসিয়া শুধু ক্ষমা করিতে ভালবাসে। তুমি যখন ঐ স্বর্ণ সিংহাসনে বসিবে, তখন কি করিবে যমুনা?’
যমুনা বলিত—‘আমি নিজে বিচার করিব। অপক্ষপাত বিচার করিয়া যে দোষী তাহাকে নিশ্চয় শাস্তি দিব। দোষ করিলে আমি কাহাকেও ক্ষমা করিব না।’
বৃদ্ধ রাজা হাসিতেন। বলিতেন—‘মা, ক্ষমা কেহ করে না—ক্ষমা হৃদয় হইতে আপনি বাহির হইয়া দোষীর দোষটুকুকে এমন স্নেহের সহিত কোলে লইয়া বসে যে রাজাও সে মুখ দেখিয়া নিজের চোখের জল সামলাইতে পারে না। ক্ষমা আপনি ক্ষমা করে। ভুল প্রমাদের সংসারে এ স্বর্গীয় প্রবৃত্তি মানুষের হৃদয়ের একটি ছোট নির্জন প্রান্তে বসিয়া থাকে, প্রয়োজন হইলে সে শতমুখী অমৃত প্রস্রবিণীর মত ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়ে; কেহই তাহার গতিরোধ করিতে পারে না। আমিও সে গতিরোধ করিতে পারি না—তাই লোকে বলে—বৃদ্ধ অজয় সিংহ শুধু ক্ষমা করিতেই আছে।’
‘আমি কিন্তু নিজেই বিচার করিব—মিছামিছি কখন ক্ষমা করিব না।’
‘যদি কখন আমার বয়স পাও’—বৃদ্ধ রাজা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘যদি কখন তেমনটি ঘটে, তখন দেখিতে পাইবে রাজা হইয়া রাজসিংহাসনে বসিয়া বিচার করার মত ঘৃণার কাজ আর নাই—যখন দেখিতে পাইবে একটি মাত্র কথার জন্য হৃদয়ের সমস্ত রক্ত ছুটিয়া গিয়া ব্যাকুলভাবে দোষীর পদতল ধৌত করিয়া দিবার জন্য তুমুল তুফান তুলিয়াছে, তখন তোমার এই বৃদ্ধ পিতার কথা মনে করিবে ত?’
যমুনার চক্ষে জল আসিল, বলিল—‘সে কি বাবা?’
বৃদ্ধ রাজা মলিনমুখে হাসিয়া কহিলেন—’যখন যৌবনকাল ছিল তখন সিংহাসনে বসিয়া বিচার করিতাম; এখন আর সে ক্ষমতা নাই। এখন দেখিতেছি, এ বিশ্বে শুধু একজন বিচারকর্তা আছেন; তিনি পাপ-পুণ্যের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই বলিতে পারেন—কে দোষী, কে নির্দোষ। আমরা মাত্র শুধু বিচারের ভান করি আর অবিচার করি।
দুই
রাজরাজেশ্বরী যমুনাবাই স্বর্ণসিংহাসনে বসিয়া মাথার হেমমুকুট ধীরে ধীরে কম্পিত করিয়া বলিলেন—’রাঠোন রাজ্যে মহোৎসবের আয়োজন কর মন্ত্রি, সাত দিনের মধ্যে নগরে যেন কোন দুঃখের চিহ্ন না দেখা যায়। যে দরিদ্র তাহাকে অর্থ দাও। যাহার যাহাতে প্রয়োজন তাহাই দেওয়া হউক, সকলে যেন সুখে ও সন্তোষের সহিত থাকে। যাহাকে সন্তুষ্ট করিতে পারিবে না তাহাকে তাড়াইয়া দাও—রাজাজ্ঞায় দুঃখী দুর্ভাগার স্থান নগরের বহির্দেশে হইয়াছে। দুর্জয় সিংহ!’
‘মহারানি!’
‘এতদিনে তুমি তোমার পদের গৌরব রক্ষা করিয়াছে। রাঠোন রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। এই তোমার পুরস্কার।’ যমুনাবাই নিজ গলদেশ হইতে বহুমূল্য মুক্তার মালা লইয়া তাঁহার হস্তে দিলেন। দুর্জয় সিংহ নতজানু হইয়া বহু সম্মানে সে পুরস্কার মস্তকে গ্রহণ করিলেন। ‘মহারানীর জয় হোক।’
মহারানী কহিলেন, ‘দুর্জয় সিংহ, এই সভামধ্যে বর্ণনা কর কেমন করিয়া সেই কণ্টককে টানিয়া বাহির করিয়াছে, কেমন করিয়া সেই অধম পাপিষ্ঠ চেত্তা রাজপুত্রকে বন্দী করিয়া সমগ্র রাঠোন রাজ্যের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছ।’