তার জবাবটা ক্ষিতীশ নিজেই দিলে। সে উপরের বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বললে, শরীরটা আমার ভাল নেই হরেন, আর ঠাণ্ডা লাগাবো না।
হরেন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বললে, ভাল নেই? তাহলে হিমে আর দাঁড়িয়ো না ক্ষিতীশ, ঘরে যাও, আমি এদের পৌঁছে দিয়ে এসে তোমাকে জানাবো।
মোটর ছেড়ে দিলে। হরেনের উপদেশ তার কানে গেল কিনা কে জানে, কিন্তু গাড়ি যখন বহুক্ষণ তার চোখের বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল, তখনও সে তেমনি সেই দিকে চেয়ে তেমনি স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইল।
স্টেশনে পৌঁছে, টিকিট কিনে দু’জনকে গাড়িতে তুলে দিয়ে হরেন কমলার কাছে গিয়ে একটুখানি লজ্জার সঙ্গে বললে, আমার উপস্থিত ঠিকানা যদিচ আমি নিজেই জানিনে, তবুও আমাকে খবর দেবার যদি আবশ্যক হয় ত কেয়ার অফ্—
অরুণ পকেট থেকে তাড়াতাড়ি এক টুকরো কাগজ আর পেন্সিল বার করে বললে, থামো থামো হরেনদা, ঠিকানাটা তোমার লিখে নিই। তাছাড়া শুনলুম, ক্ষিতীশদাও আজ দুপুরের ট্রেনে পশ্চিমে চলে যাচ্ছেন। এটা ছাই মনে হোলো না যে তাঁর ঠিকানাটা জিজ্ঞেসা কোরে রাখি।
সংবাদ শুনে কমলা মনে মনে আশ্চর্য হলো, কিন্তু কিছুই প্রকাশ করলে না। কিন্তু হরেন উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো, বলিস কি অরুণ! তাহলে ত আমাকে এখুনি ফিরে গিয়ে তাকে থামাতে হয়!
কমলা মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলে, কেন হরেনদা?
অরুণ বললে, কেন কি, বাঃ—
হরেন বললে, সেখানে কত কি ঘটতে পারে কে বলতে পারে? অন্যায় হলে আমি ত যাবই, এমন কি ক্ষিতীশকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে যেতে ছাড়বো না! তুই কি আমাকে ভীরু মনে করিস?
কমলা ঘাড় নেড়ে বললে, না, তা করিনে। কিন্তু তোমাদের কারও সেখানে আমার জন্যে যাবার দরকার হবে না।
হরেন ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললে, হবে না? নাই হোক, কিন্তু আজও কি তুই আমাদের পাড়াগাঁয়ের লোকগুলোকে চিনিস নি কমলা?
কমলা এ প্রশ্নের ঠিক জবাব দিলে না, বললে, আমি কিছুতে ভেবে পাইনে হরেনদা, এতদিন কি করে আমার সমস্ত বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছিল, আর কেমন করেই বা এতদিন নিজের কাজের ভার তোমাদের পরের ওপর নির্ভর করে থাকতে পেরেছিলুম। ভুল যা করেচি তার সীমা নেই, কিন্তু তোমাদের সাক্ষী দিতে ডেকে পাঠাবো এত বড় ভুল বোধ হয় আমিও আর কোরবো না।—এই বলে সে ছোটভাইয়ের হাত থেকে কাগজের টুকরোখানি নিয়ে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিলে।
হরেন মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং লজ্জিত হয়ে বললে, কিন্তু কমলা, নির্দোষীকেও কি সাক্ষী দিয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমান করতে হয় না?
কমলা একটুখানি ম্লান হেসে বললে, সে আদালতে হয়, কিন্তু আমার বিষয়ের ভার যাঁর হাতে তুলে দিয়েচি হরেনদা, তাঁকে সাক্ষী যোগাতে হয় না, তিনি আপনিই সব জানেন।
এই বোলে সে উদ্গত অশ্রু গোপন করতে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলে।
গার্ডসাহেব সবুজ নিশান নেড়ে দিলেন, ড্রাইভার বাঁশী বাজিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলে। এই সময়টুকুর মধ্যে হরেন যেন একটা ধাক্কা সামলে নিলে। সে সঙ্গে সঙ্গে দু’পা এগিয়ে এসেও কমলার মুখ আর দেখতে পেলে না, কিন্তু তাকেই উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললে, তাই যেন হয় বোন, আমি কায়মনে প্রার্থনা করি তিনিই যেন আমাদের বিচারের ভার গ্রহণ করেন।
কমলা এ কথার কোন উত্তর দিল না, দেবার ছিলই বা কি! কিন্তু গাড়ি কতকটা পথ চলে গেলে সে কেবলমাত্র একটিবার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেলে হরেন এখনও সোজা তাদের দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পথের মধ্যে অরুণ অনেক কথাই বকে যেতে লাগল। তার নিজের প্রতি ভারী একটা ভরসা ছিল। সেই যে দুর্গামণি তাকে বলেছিলেন, তিনি গুজবটা বিশ্বাস করেন নি, এবং সেও তাকে জানিয়ে এসেছে, কলকাতায় দিদি তার কাছেই আছেন, এতেই তার সাহস ছিল, দুর্ঘটনাটাকে সে অনেকখানিই সহজ করে দিয়েছে। এই ভাবের সান্ত্বনাই সে থেকে থেকে দিদিকে দিয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু দিদি যেমন নিঃশব্দে ছিল, তেমনি নীরবেই বসে রইল। হরেনের সেই কথাটা সে ভোলেনি যে অরুণের এই কথাটা সহজে কেউ বিশ্বাস করবে না! কিন্তু এজন্য মনের মধ্যে তার বিশেষ কোন চাঞ্চল্যও ছিল না। বস্তুতঃ যা সত্য নয়, সে যদি লোকে অবিশ্বাসই করে ত দোষ দেবার কাকে কি আছে! কিন্তু যথার্থ যে-চিন্তা তার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে জাঁতার মত চেপে বসছিল, সে তার শাশুড়ীর কথা। তিনি বলেছিলেন বটে, তাঁর বধূর কলঙ্ক তিনি বিশ্বাস করেন না, কিন্তু এই বিশ্বাস কি তাঁর শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে? কোথাও কি কোন অন্তরায় কোন বিঘ্ন ঘটবে না? সে জানতো, ঘটবে। পল্লীগ্রামে মানুষ হয়েই সে এত বড় হয়েছে, তাদের সে চেনে,—কিন্তু এ সংকল্পও তার মনে মনে একান্ত দৃঢ় ছিল, অনেক ভুল, অনেক ভ্রান্তিই হয়ে গেছে, কিন্তু আর সে তার নিজের এবং স্বামীর মধ্যে তৃতীয় মধ্যস্থ মানবে না। এ সম্বন্ধ যদি ভেঙ্গেও যায় ত যাক্, কিন্তু জগদীশ্বর ভিন্ন দুজনের মাঝখানে অন্য বিচারক সে কখনো স্বীকার করবে না।
বেলতলী স্টেশনে যথাসময়েই ট্রেন এসে পৌঁছল, কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি যোগাড় করা সহজ হোলো না। অনেক চেষ্টায় অনেক দুঃখে অরুণ যখন একটা সংগ্রহ করে নিয়ে এল, তখন বেলা হয়েছে, এবং পল্লীপথের পাকা দুই ক্রোশ উত্তীর্ণ হয়ে অশ্বযান যখন জগদীশপুরের সতীশ বাগচীর বাটীর সুমুখে উপস্থিত হল তখন বেলা বারোটা।
দুর্গামণি গোটা-তিনেক ময়লা ওয়াড়হীন তুলো-বার-করা বালিশ জড়ো করে ঠেস দিয়ে বসে এক বাটি গরম দুধ পান করছিলেন, এবং অদূরে মেঝেয় বসে পাড়ার একটি বিধবা মেয়ে কুলোয় খৈয়ের ধান বাচছিল। দুর্গামণির জ্বর তখনও একটু ছিল বটে, কিন্তু টাইফয়েডের কোন লক্ষণই নয়। তিনি অরুণকে দেখে খুশী হয়ে বললেন, কে অরুণ এসেছো বাবা? এসো বোসো। দোরগোড়ায় ও কে গা?