হরেন বললে, দূর পাগলা! তুই ছেলেমানুষ, কলকাতায় কমলা তোর কাছে আছে, এ কথা কেউ কখনো বিশ্বাস করে? কি বল হে ক্ষিতীশ?
ক্ষিতীশ হঠাৎ চমকে উঠে বললে, হুঁ। বলেই লজ্জিত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে একটুখানি হেসে বললে, আমার ভারী ঘুম পাচ্চে হরেন, আমি চললুম।—বলে ঠিক যেন টলতে টলতে তার নিজের ঘরে চলে গেল।
নিজের বাড়িতে তাদের কোন খেয়াল না করে ক্ষিতীশ শুতে গেল, এটা তার স্বভাবের এমনি বিরুদ্ধ যে হরেন ও অরুণের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কিন্তু যথার্থই আজ ক্ষিতীশের এদিকে দৃষ্টি দেবার সাধ্যই ছিল না। বহুক্ষণ থেকেই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, এত আলোচনা ও তর্কবিতর্ক অর্ধেক বোধ হয় তার কানেই যায়নি। সেখানে কেবল একটা কথাই বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, সমস্ত প্রকাশ হয়ে গেছে, সমস্ত প্রকাশ হয়ে গেছে! তার মনের নিভৃত গুহায় যত কিছু আশা সঞ্চিত হয়ে উঠছিল, কমলার কাছে সমস্ত ধরা পড়ে গেছে, তার কোথাও কিছু আর লুকোনো নেই! তাই সে আজ ভয়ে ভীত হরিণীর মত ছুটে পালাতে চায়। আজ তার সকল যত্ন, সকল সেবা, সকল পরিশ্রম একেবারে ব্যর্থ, একেবারে নিরর্থক।
বাইশ
ক্ষিতীশদা!
কে?
আমি কমলা, একবারটি দোর খোল।
ক্ষিতীশ শশব্যস্তে দোর খুলে বাইরে এসে দেখলে, সুমুখে দাঁড়িয়ে কমলা। রাত্রির ঘোর তখনও কাটেনি, তখনো আকাশে দু’-চারটে বড় বড় তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কেবল পূবের দিকটা একটু স্বচ্ছ হয়েছে মাত্র। বারান্দার এককোণে যে লন্ঠনটা মিটমিট করে জ্বলছিল, তারই সামান্য আলোতে ক্ষিতীশ চক্ষের নিমেষে সমস্ত ব্যাপারটা দেখে নিলে।
কমলার গায়ে আগাগোড়া একটা হলদে রঙের র্যাপার জড়ানো, এবং তারই অদূরে দাঁড়িয়ে অরুণ। তার ডোরা-কাটা কোটের ওপর কোমরে বাঁধা একটা আধ-ময়লা চাদর। বাঁ হাতে তার পৈতের সময়কার লাল রঙের ছাতাটি এবং ডান বগলে একটি ছোট্ট পুঁটুলি।
কেবল এতটুকুই ক্ষিতীশ দেখতে পেল। কিন্তু কমলা যখন গড় হয়ে প্রণাম করে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ক্ষিতীশদা আমি চললুম, তখন আলোর অভাবেই হোক, বা চোখের দোষেই হোক, তার মুখের কিছুই আর ক্ষিতীশের চোখে পড়ল না। তার মনে হল, অকস্মাৎ একমুহূর্তে যেন সন্মুখে, পাশে, ওপরে, নীচে সমস্তটাই একেবারে মসীকৃষ্ণ হয়ে গেছে।
—আমাদের সময় হয়েছে, আমি যাচ্ছি ক্ষিতীশদা।
—যাচ্ছো? আচ্ছা—
—আমি কোথাকার কে, তবু কত কষ্টই না এতদিন ধরে তোমাকে দিলাম, এই বলে কমলা
র্যাপারের কোণে চোখ মুছলে।
প্রত্যুত্তরে ক্ষিতীশ শুধু জবাব দিলে, কষ্ট? কৈ, নাঃ—
—কিন্তু তোমার প্রাণবাঁচানো যেন নিষ্ফল না হয়, যাবার সময় আমাকে এইটুকু আশীর্বাদ কেবল তুমি কর ক্ষিতীশদা—এই বলে কমলা ঘন ঘন চোখ মুছতে লাগল।
ক্ষিতীশ কোন উত্তরই খুঁজে পেলে না। কিন্তু খানিক পরে হঠাৎ বলে উঠল, আশীর্বাদ? নিশ্চয়! নিশ্চয়! তা করব বৈ কি। হাঁ অরুণ, মোটরটা বলে দেওয়া হয়েছে?
অরুণ মাথা নেড়ে জবাব দিলে, হাঁ। হরেনদা ত নীচে তাতেই বসে আছেন! তিনি ইস্টিশান পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিয়ে আসবেন। আপনি যাবেন না?
আমি? না ভাই, আমার শরীরটা তেমন ভাল নেই—
কমলা দূর থেকে আর একবার নিঃশব্দে নমস্কার কোরে আস্তে আস্তে নীচে চলে গেল। অরুণ কাছে এসে বললে, আমিও চললুম ক্ষিতীশদা,—এই বলে সে দিদির মত প্রণাম করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্ষিতীশ সহসা সজোরে তার হাত দুটো ধরে হিড়হিড় করে টেনে তার ঘরের মধ্যে এনে ফেলে বললে, অরুণ, তোমরা সত্যি সত্যি চললে ভাই?
অরুণ অবাক হয়ে তার পানে চেয়ে রইল, প্রশ্নটা যেন সে বুঝতেই পারলে না।
ক্ষিতীশ পুনরায় বললে, কে জানে আর হয়ত আমাদের দেখাই হবে না,—আমিও আজ দুপুরের গাড়িতে পশ্চিমে চললুম ভাই।
অরুণ এ কথারও কোন জবাব দিতে পারলে না, কিন্তু বালক হলেও সে এটুকু বুঝতে পারল যে, ক্ষিতীশদার কণ্ঠস্বর কান্নার জলে যেন একেবারে মাখামাখি হয়ে গেছে।
ক্ষিতীশ প্রত্যুত্তরে আশা না করেই বললে, তুমি ছেলেমানুষ, তোমার ওপর যে কত বড় ভার পড়ল এ হয়তো তুমি জানোও না, কিন্তু ভগবানের কাছে আমি কায়মনে প্রার্থনা করি, তোমাদের আজকের যাত্রাটা যেন তিনি সকল প্রকারে নির্বিঘ্ন কোরে দেন।
এই বলে সে তার বালিশের তলা থেকে একখানা খাম বার করে অরুণের হাতে গুঁজে দিতে গেল। অরুণ হাতটা সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এ কি ক্ষিতীশদা?
সামান্য গোটা-কয়েক টাকা আছে অরুণ।
কিন্তু ভাড়ার টাকা ত আমার কাছে আছে ক্ষিতীশদা।
তা থাক। তবু ছোট ভাইদের যাবার সময় কিছু হাতে দিতে হয়। এই বোলে সে অরুণের কোঁচার খুঁটটা টেনে নিয়ে তাতে বাঁধতে বাঁধতে বললে, তোমার ত কেউ বড় ভাই নেই অরুণ, তাই জানো না, নইলে তিনিও এমনি করেই বেঁধে দিতেন, দাদার স্নেহের উপহার বলে নিতে কিছু লজ্জা কোরো না ভাই! তোমার দিদি কখনো যদি জানতে পেরে জিজ্জাসা করেন, তাঁকেও এই কথাটাই বোলো।—এই বলে সে সেটা যথাস্থানে পুনরায় গুঁজে দিয়ে হাত ধরে তাকে বাইরে এনে বললে, আর সময় নেই অরুণ, তুমি যাও ভাই, সাড়ে-চারটে বেজে গেছে। ওঁরা বোধ করি বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন—এই বলে সে একরকম তাকে জোর করে বিদায় কোরে দিলে।
অরুণ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলে, আপনি কতদিন পশ্চিমে থাকবেন ক্ষিতীশদা?
সে কথা আজ কি কোরে বলব ভাই?
মিনিট-খানেক পরে অরুণ গিয়ে যখন গাড়িতে উঠে বোসলো, তখন তাকে একাকী দেখে কমলা কোন প্রশ্নই করলে না, কিন্তু হরেন জিজ্ঞাসা করলে, ক্ষিতীশ এলো না অরুণ—